বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে গত সোম ও গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা-সম্পর্কিত দুটি প্রতিবেদনে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা আমাদের মোটেই আশাবাদী করে না।
প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্য জনবলে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নিচে একমাত্র আফগানিস্তান। অন্য প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়লেও শেষ ১০ বছর অসুস্থ থাকেন। কেবল জনবল নয়, জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার বরাদ্দও দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ১১০ ডলার। এক দশক ধরেই স্বাস্থ্যে সরকারি ব্যয় সর্বমোট সরকারি ব্যয়ের ৫ শতাংশের মধ্যে ছিল; যদিও কোভিডের কারণে চলতি অর্থবছরে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।
গত রোববার জেনেভায় ৭৫তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলন উপলক্ষে স্বাস্থ্য খাতের পরিসংখ্যান নিয়ে বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এসডিজি অর্জনের জন্য তৈরি করা জনবল কৌশলপত্র অনুযায়ী, ১ হাজার মানুষের সেবা দেওয়ার জন্য ৪ দশমিক ৪৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ এর ধারেকাছেও নেই। এখানে ১ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক আছে শূন্য দশমিক ৬৭ জন, নার্স ও মিডওয়াইফ শূন্য দশমিক ৪৯ জন। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে ৭৪ শতাংশ চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ কম আছে।
প্রতিবেদনে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ জন্য বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত ছিল বা আছে। প্রস্তুত যে ছিল না, তার প্রমাণ কোভিডকালে স্বাস্থ্য খাতের বেহাল। স্বাস্থ্যসেবার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার সূচক অনুযায়ী সেবার আওতায় আছে। এর অর্থ ৪৯ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন সেবা পায় না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো স্বাস্থ্যসেবায় যে অর্থ খরচ হচ্ছে, তার জোগান কোত্থেকে আসে? ২৪ শতাংশ মানুষের পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশ চলে যায় চিকিৎসা খরচ মেটাতে। ৮ শতাংশের বেশি মানুষ পারিবারিক আয়ের ২৫ শতাংশের বেশি খরচ করে এ খাতে। চিকিৎসার জন্য বাড়ি-জমি বিক্রি করে দিয়েছেন এ রকম মানুষও কম নয়।
স্বাস্থ্য খাতে কেবল লোকবলের ঘাটতি নয়, বরাদ্দের দিক থেকেও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। গত বছর স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ৭ শতাংশ বরাদ্দ করা হলেও তার একটি বড় অংশ ব্যয় হয়েছে কোভিড মোকাবিলায়। এবার কোভিডের সংক্রমণ খুবই কম। ফলে কোভিডবহির্ভূত স্বাস্থ্যসেবার দিকে সরকারকে অধিক নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু (পুরুষ ৭৩ বছর ও নারী ৭৫ বছর ৬ মাস) বেড়েছে, এটি আশার কথা। কিন্তু তঁাদের একাংশ যদি শেষ বয়সে নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে থাকেন, তাতে দুই ধরনের ক্ষতি হয়। প্রথমত পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবায় অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। দ্বিতীয়ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সেবা থেকেও দেশ বঞ্চিত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে এবং সেই অর্থ ব্যবহারেও যথাযথ নজরদারি থাকবে। আরও অনেক খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের ক্ষেত্রেও দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন অবস্থান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।