লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে ‘বাংলা বন্ড’ নামে একটি দেশীয় মুদ্রার বন্ড চালু হওয়ার সংবাদটি আমাদের জন্য একটি সুসংবাদ। কেননা, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে অর্থায়নের সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে আমাদের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৩ শতাংশ; প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারা বেগবান করে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের হার বাড়িয়ে জিডিপির অন্তত ৩০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে বাংলা বন্ড সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং এই আশা বাস্তবসম্মত।
আন্তর্জাতিক অর্থবাজারে বাংলাদেশি মুদ্রায় বন্ড ছাড়ার ঘটনা এই প্রথম। আমাদের সরকারের অনুমোদনক্রমে বাংলা বন্ড ছেড়েছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতসংক্রান্ত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। এই বন্ডের মাধ্যমে সংস্থাটি ইতিমধ্যে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার সমান। বাংলা বন্ডের মাধ্যমে আইএফসির সংগৃহীত অর্থ ঋণ পাবে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যেমন, প্রথম ধাপে ৮০ কোটি টাকা ঋণ পাচ্ছে প্রাণ গ্রুপ; তারা এই অর্থ পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সামর্থ্য বাড়ানো ও গ্রামাঞ্চলে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা সম্প্রসারণের কাজে বিনিয়োগ করবে বলে জানা গেছে।
আমাদের বেসরকারি খাতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন; বিশেষত অবকাঠামো, ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ, আবাসন ও নানা রকমের আধুনিক সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যে অর্থায়ন প্রয়োজন, তা দুর্লভ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আহরণের চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু তারা দেশের ভেতরে আয় করে দেশীয় মুদ্রায়। বাংলা বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ থেকে তারা ঋণ গ্রহণ করলে তার সুদ টাকায় পরিশোধ করতে পারবে—এই ব্যবস্থা তাদের পক্ষে সুবিধাজনক হবে। তা ছাড়া স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিলে তাদের যে হারে সুদ প্রদান করতে হয়, বাংলা বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ থেকে ঋণের ক্ষেত্রে তার চেয়ে কম হারে সুদ প্রদান করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদের হার মেয়াদভেদে ১১ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে; আর প্রাণ গ্রুপ আইএফসি থেকে ঋণ পেতে যাচ্ছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ সুদহারে।
বাংলা বন্ডে বিনিয়োগ করছে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। ব্যক্তি বিনিয়োগকারী বা প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। যেহেতু বন্ডের সুদ পরিশোধ করা হবে টাকায় এবং বিনিয়োগকারীরা তা তাদের সুবিধামতো মুদ্রায় রূপান্তর করবে, তাই মুদ্রার বিনিময়জনিত ঝুঁকি বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই বহন করবে। এই বন্ড টাকায় ছাড়ার ফলে বাংলাদেশি মুদ্রা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত লাভ করবে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ওপর তার প্রভাব হবে ইতিবাচক। তা ছাড়া বাংলা বন্ডের সাফল্য অর্জিত হলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সভরেন বন্ড ছাড়ার সম্ভাবনাও
উজ্জ্বল হবে।
আইএফসি আন্তর্জাতিক অর্থবাজারে বাংলাদেশি মুদ্রায় বন্ড চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সম্ভবত আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক অগ্রগতি লক্ষ করে। এই প্রাণবন্ত অর্থনীতির প্রধান খাত বেসরকারি খাত; বাংলা বন্ডের মাধ্যমে এই খাতে আরও বেগ সঞ্চারের যে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হলো, তা যথাযথভাবে কাজে লাগানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই উৎস থেকে অর্থায়ন পাবে, তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের ওপরেই নির্ভর করবে বাংলা বন্ডের চূড়ান্ত সাফল্য। সে জন্য সহজে ব্যবসার সুযোগের ক্ষেত্রে এখনো বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।