একসময় বরিশাল অঞ্চল বাংলাদেশের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই অঞ্চলটি যে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের চেয়েও বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছে—এটি একটি বিস্ময়কর তথ্য। নতুন এ তথ্য পাওয়া গেল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং এবং আইসিডিডিআরবির একটি যৌথ জরিপ থেকে। গত সোমবার প্রথম আলোয় এ সম্পর্কে এক বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে বরিশাল বিভাগে দরিদ্র খানার হার ৪১ দশমিক ২ শতাংশ। এটাই খানাভিত্তিক দারিদ্র্যের সর্বোচ্চ হার। এর পরেই রয়েছে রংপুর বিভাগ; সেখানে দরিদ্র খানার হার ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ একসময়ের দরিদ্রতম বিভাগের তুলনায়ও বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্য বেশ বেড়েছে। বরিশাল বিভাগের মধ্যেই পড়েছে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা; সেটা পটুয়াখালী। এ জেলায় দরিদ্র খানার হার বিভাগভিত্তিক হারের তুলনায় অনেক বেশি—৬০ দশমিক ৬ শতাংশ। পটুয়াখালীর পরই আছে রংপুর বিভাগের জেলা কুড়িগ্রাম—এককালে যেটি মঙ্গাপীড়িত জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে এখন দরিদ্র খানার হার ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
দারিদ্র্যের এ চিত্র নিরূপণের ক্ষেত্রে উল্লিখিত জরিপে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে পারিবারিক আয়, ঘরবাড়ির অবস্থা, বিদ্যুৎ–সংযোগ থাকা বা না–থাকা, বাড়িতে শৌচাগার কী ধরনের, খানার সদস্যরা টেলিভিশন ও মুঠোফোন ব্যবহার করেন কি না ইত্যাদি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও এ ধরনের খানা জরিপ করে থাকে। সেখানে খানার আয় ও ব্যয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্যের মাত্রা নিরূপণ করা হয়। এ দুই পদ্ধতির মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও মোটের ওপর এটা পরিষ্কার যে বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্য আগের তুলনায় বেড়েছে, বিশেষত পটুয়াখালী জেলার অবস্থা রংপুরের কুড়িগ্রাম জেলার থেকেও খারাপ হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, বরিশাল বিভাগের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার এ অবনতির কারণ কী? দেখা যাচ্ছে, বরিশাল বিভাগে মানুষের কর্মসংস্থান অপেক্ষাকৃত কম, অর্থনৈতিক তৎপরতা এবং প্রবাসী আয়ও কম। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো জমির লবণাক্ততার কারণে ওই অঞ্চলে কৃষি মূলত আমন ধাননির্ভর, যা বছরে মাত্র একবারই ফলে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রবক্ষের উচ্চতা দিনে দিনে বেড়েছে, নদ–নদীর নাব্যতা কমেছে, ফলে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে এবং কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বরিশালসহ পুরো দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকাটি ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। তার ফলে শুধু কৃষির ক্ষতি নয়; ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, মাছের ঘেরসহ আরও নানা ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী এবং সম্প্রতি আম্পানসহ অনেক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এক দশকের বেশি সময় ধরে ওই অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বিশেষত বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে যাওয়ায় ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কৃষিজমিতে লোনা পানি ঢুকে মাটির লবণাক্ততা বেড়েছে।
পটুয়াখালীসহ পুরো বরিশাল বিভাগে মানুষের দারিদ্র্য বৃদ্ধির এ প্রবণতা রোধ করতে হলে বহুমুখী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সে জন্য এমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর ওপর বেশি জোর দিতে হবে, যাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। আর কৃষিব্যবস্থার উন্নতির জন্য বেড়িবাঁধগুলো মেরামত করে লবণাক্ততা বৃদ্ধি প্রতিহত করতে হবে এবং লবণাক্ততা সহনক্ষম জাতের ফসল উদ্ভাবন ও ফসলের বৈচিত্র্য বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। কৃষিভিত্তিক ও মৎস্যভিত্তিক শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিলে সেখানে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার মাধ্যমে দারিদ্র্য বৃদ্ধির এ ধারা থামানো সম্ভব।