বনভূমিতে প্রশাসন একাডেমি কেন

সম্পাদকীয়

প্রশাসন একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে ৭০০ একর বনভূমি বন্দোবস্ত নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জমির মালিক বন বিভাগ হলেও বন্দোবস্ত দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

রোববার প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ওই এলাকা প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় এই বনভূমি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। বন আইন অনুযায়ী, এ ধরনের রক্ষিত বনে কোনো ধরনের স্থাপনা করা নিষিদ্ধ। ১৯৯০ সালে জারি করা পরিপত্রে ভূমি মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড় ও পাহাড়ের ঢাল বন্দোবস্তযোগ্য নয় এবং ওই জমি মূলত বন বিভাগ বনায়নের জন্য ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছিল। এখন তারা মেরিন ড্রাইভের সড়কসংলগ্ন ভূমি ইজারা দিয়ে নিজেরাই সেই বিধান অমান্য করছে।

সব আইন ও বিধি উপেক্ষা করে জনপ্রশাসন ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের এই যৌথ কর্মসম্পাদনা দেখে মনে হতে পারে, কক্সবাজারের রক্ষিত বনভূমি ছাড়া ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের অন্য কোথাও প্রশাসন একাডেমি করা যাবে না এবং বন বিভাগের জমি দখল বা ইজারা নিয়েই করতে হবে। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যে আপত্তি জানিয়েছিল, তা–ও তারা আমলে নেয়নি।

আরও অবাক ব্যাপার যে প্রশাসন একাডেমির জন্য জমি বরাদ্দ দিতে ভূমি মন্ত্রণালয় অসত্য তথ্য দিয়েছে। তারা বনভূমিকে ‘অকৃষি খাসজমি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের নিশ্চয়ই অজানা নয় অকৃষিজমি ও বনভূমি এক নয়। নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৮ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন বঙ্গবন্ধু একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (বাপা) কার্যালয় নির্মাণের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অনাপত্তিপত্র চায়। সংস্থাটি ওই বছরই ১৪টি শর্তে অনাপত্তিপত্র দেয়। পরিবেশ অধিদপ্তর মূলত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এর মহাপরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর পরিচালকেরা প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। জমির মূল্য ধরেছে ৪ হাজার ৮০৩ কোটি ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু একাডেমির জন্য প্রতীকী মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১ লাখ টাকা। এই কাজ ভূমি মন্ত্রণালয় করতে পারে না।

কক্সবাজারে বনভূমি ও পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণের উদাহরণ এটাই প্রথম নয়। পূর্বাপর সব সরকারের আমলেই বনভূমি উচ্ছেদ ও পাহাড় ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, সরকারের এক বিভাগ আরেক বিভাগকে জমি দিয়েছে, তাতে সমস্যা কী। এর মাধ্যমে পরিবেশ ও বন-পাহাড় রক্ষার বিষয়টি তিনি উপেক্ষা করেছেন। ভূমি মন্ত্রণালয় চাইলেই যেকোনো অকৃষিজমি অন্য বিভাগকে দিতে পারে না। তার পক্ষে আইন ও বিধি থাকতে হবে।

প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাভার ও ঢাকার শাহবাগে প্রশাসন একাডেমি আছে। তারা যদি মনে করে, আরও একাডেমি প্রয়োজন, অন্য কোথাও করতে পারত। এ জন্য কক্সবাজারের বনভূমি দখল করতে হবে কেন? একটি একাডেমির জন্য ৭০০ একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে তারা। অথচ ভারতে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ১২৭ একর জমিতে একাডেমি করা হয়েছে। সরকারের অনেক দপ্তর ও বিভাগের কক্সবাজারের অফিস বা আবাসিক ভবন ব্যবহার করা হয় বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে। জমির পরিমাণ ও স্থান বিবেচনায় নিলে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে এটা কি প্রশিক্ষণ একাডেমি হবে, নাকি বিনোদনকেন্দ্র?

এই জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গ হয়েছে। বেআইনি এই বরাদ্দ বাতিল করতে হবে। সেটা নিশ্চিত করা না গেলে এভাবে বনভূমি ও প্রকৃতি ধ্বংস করার দায় প্রশাসনকে নিতে হবে এবং তা প্রশাসনের জবরদস্তিমূলক আচরণ হিসেবেই বিবেচিত হবে।