সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের আগে সরকার তথা ওই কর্মচারীর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে—এ রকম বিধান রেখে গত রোববার ‘সরকারি চাকরি বিল ২০১৮’ শীর্ষক যে বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে, আমরা মনে করি তা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। কেননা, সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না, কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’ অন্যদিকে সমাজের অনগ্রসর অংশের ক্ষেত্রে যে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা সংবিধানে আছে, তা কোনোভাবে সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। তাঁরা সমাজের অনগ্রসর অংশ নন। এ আইনটি কার্যকর হলে দুর্নীতি দমন কমিশন শুধু নখদন্তহীন বাঘেই পরিণত হবে না, এ-সংক্রান্ত আইনগুলোও সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়বে।
তবে এই বিলে সরকারি কর্মচারীদের মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ এবং সেবাপ্রার্থীদের সেবাদানে সরকারি কর্মচারীরা ব্যর্থ হলে যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে তাদের জবাবদিহির যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি সমর্থনযোগ্য বলে মনে করি।
উল্লিখিত বিলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত সরকারি কর্মচারী যেই সুবিধা পাবেন, বাইরের কোনো ব্যক্তি এমনকি জনপ্রতিনিধিও সেই সুযোগ পাবেন না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা চাইলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা শুধু বৈষম্যপূর্ণ নয়, সংবিধানের মৌলিক চেতনারও বিরোধী।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়েও যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৫ ধারায়ও এ বিধান বলবৎ রাখা হয়েছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এত দিন পর সেটি পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ল কেন?
প্রস্তাবিত বিলটি কার্যকর হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে যদি হাতেনাতে ধরে ফেলে, তারপরও তারা তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের এই ছাড় দেওয়ার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কেননা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সরকারি কর্মচারী বা অকর্মচারী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অভিযুক্ত হিসেবে। অন্যান্য অভিযুক্ত যেমন আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করবেন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য সেই সুযোগ থাকবে। এখানে বিচারের আগেই কেউ দায়মুক্তি পেতে পারেন না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যখন আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে, তখন আমরাও এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, ‘কোনো কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধের কারণে দণ্ডিত হলে রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ও চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারণকৃত ব্যক্তিকে অনুরূপ বরখাস্ত বা অপসারণ থেকে অব্যাহতি প্রদানের বিশেষ কারণ বা পরিস্থিতি রয়েছে, তাহলে তিনি ওই ব্যক্তিকে ওই শাস্তি থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে ওই কর্মচারী পুনরায় চাকরিতে বহাল হবেন।’ এর মাধ্যমে কেবল অভিযুক্ত কর্মচারীই নন, দণ্ডিত সরকারি কর্মচারীও দায়মুক্তি পাবেন, যা আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। যে আইন সবাইকে সমান সুযোগ দেয় না, সেই আইন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।