বিদেশে ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন। এটি আনন্দের খবর হলেও বেদনার খবর হলো, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা ও প্রভাব নিয়ে।
মাত্র দুটি ব্যাংক প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যেতে ঋণ দিয়ে থাকে—রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক অগ্রণী ও বেসরকারি প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক। ২০১১-১২ অর্থবছরে শুরু হওয়া প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ১১২ কোটি টাকা। আর অগ্রণী ব্যাংক প্রবাসী শ্রমিকদের ঋণ দেওয়া শুরু করে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তারা ঋণ দিয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য।
ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে কিছু কড়াকড়ি থাকায় এবং অন্যান্য ব্যাংক ঋণ না দেওয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এবং স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হন। এ ছাড়া অনেকে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা জমিজমা বিক্রি করেও বিদেশে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ঋণ সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঋণ আবেদনের দীর্ঘসূত্রতা কমানো এবং ঋণ আদায়ে তদারকি বাড়ানো। অন্যান্য ব্যাংককেও প্রবাসী শ্রমিকদের ঋণদানে এগিয়ে আসা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করারও প্রস্তাব করেছে তারা।
এই প্রতিবেদনে প্রবাসী শ্রমিকদের অদক্ষতা ও লুক্কায়িত যে খরচের কথা বলা হয়েছে, তার প্রতি এখনই নজর দেওয়া উচিত। একশ্রেণির আদম ব্যাপারী নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ নিয়ে বিদেশে শ্রমিক পাঠান। অনেক সময় ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে শ্রমিকদের পাঠানো হয়, যাঁরা বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ এবং ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ। এই তথ্য আমাদের শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে প্রবাসে শ্রমিক নিয়োগ অবিলম্বে কমে যেতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পাস করা শ্রমিকদের হার যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করা শ্রমিকের হার ২৩ দশমিক ২ ও ১২ দশমিক ২ শতাংশ। এর সঙ্গে বাংলাদেশে যেসব বিদেশি কাজ করেন, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য লক্ষ করা যাবে। অনেক সময় দেখা যায়, বাংলাদেশে কর্মরত একজন বিদেশি কর্মী গড়ে যে বেতন পান, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি ১০০ শ্রমিকের বেতনও তার সমান নয়। প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হচ্ছেন এবং অনেকে মেয়াদ শেষের আগেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশই কাজ করেন মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। এসব দেশেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠানোর দিকেই মনোযোগ বাড়াতে হবে। সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে যে শ্রমিকেরা যান, তাঁরা স্থানীয় ভাষা না জানায় নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের সত্যিকারভাবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, আর সে জন্য আধুনিক ও উন্নত সুবিধাসংবলিত প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প নেই। অন্যথায় ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’কে বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হবে।