পণ্য কিনে প্যাকেটে ভরে দিতে বলেন ক্রেতা। নির্বিকারে তা পলিথিনের ব্যাগে ভরে দেন বিক্রেতা। সবজিবাজার থেকে ফাস্ট ফুড শপ, মুদি দোকান থেকে শপিং মল—সবখানে এই দৃশ্য। বাড়ি ফেরার পর পণ্যটি ঘরে ঢুকলেও ব্যাগটির জায়গা হয় ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায়। তারপর নর্দমা আটকে পানি জমে বিতিকিচ্ছি অবস্থা। পরিবেশদূষণ তো আছেই। এরপরও ক্রেতা-বিক্রেতা দুপক্ষই পলিথিন ব্যবহারের পক্ষে। উভয়েই মনে করেন, জিনিসপত্র সহজেই এই ব্যাগে ভরে নেওয়া যায়। ছেঁড়ার আশঙ্কাও কম। তাঁরা বুঝতে চান না পলিথিন বা প্লাস্টিক এমন জিনিস, যা মাটিতে মেশে না। কোনো ব্যাকটেরিয়ার ক্ষমতা নেই তাকে ‘ডিকম্পোজ’ করার। তাই মাটিতে প্লাস্টিক পুঁতে ফেলার অর্থ চিরকালের মতো সেই বিষ মাটিতে থেকে যাওয়া। আবার যদি পুড়িয়ে ফেলা হয় তাহলে এর মধ্যে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসে মিশে যায়, যার প্রভাব পড়ে বাস্তুতন্ত্রের ওপর।
এই পরিবেশঘাতী সমস্যার যুগান্তকারী সমাধান করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মোবারক আহম্মেদ খান। তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ তৈরি হতে যাচ্ছে। ‘সোনালি ব্যাগ’ নামের এই ব্যাগ পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব। এই ব্যাগ তৈরিতে যুক্তরাজ্যের ফুটামুরা কেমিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে সব ধরনের মেশিনারিজ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। বিজেএমসির আশা, আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে। সোনালি ব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই।
পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে অন্যান্য পরিবেশবান্ধব দ্রব্যাদির মাধ্যমে কম্পোজিট করে সোনালি ব্যাগ তৈরি করা হয়। লতিফ বাওয়ানী জুট মিল নামের একটি কারখানায় খুব স্বল্প পরিসরে দুই বছর ধরে এ বিকল্প পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এখন যুক্তরাজ্যের সহায়তায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হবে।
পলিথিনের বিকল্পের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী। প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন পিস পলিথিন ব্যাগ সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পরিবেশবাদী আন্দোলন সক্রিয় থাকায় অদূর ভবিষ্যতে সারা বিশ্বে এটি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করা হয়। সে সময় বাংলাদেশের এই ব্যাগ বিশ্ববাজার দখল করতে পারবে। এটি প্রায় মরে যাওয়া পাটশিল্পকে আবার চাঙা করে তুলবে।
এর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং। পলিথিনের বিকল্প হওয়ায় সোনালি ব্যাগ যে বিশ্ববাজারে আলোড়ন তুলবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অন্য দেশগুলো চাইলেও এই ব্যাগ সহজে বানাতে পারবে না; কারণ কাঁচামাল হিসেবে যে পাট দরকার তার বড় উৎসই বাংলাদেশ। ফলে এই ব্যাগের প্রধান উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশই এই কৃতিত্বর ভাগীদার। এই পণ্যের গায়ে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সে জন্য এই খাতকে অগ্রাধিকারে আনা দরকার।