২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে পুড়ে ১২৪ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা যে আমাদের চৈতন্যোদয় ঘটাতে পারেনি, তার প্রমাণ ৯ বছরের ব্যবধানে গত বুধবার রাতে আরও একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। দুর্ঘটনাস্থল থেকে এ পর্যন্ত ৬৭টি লাশ উদ্ধার করা হলেও নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। আগুনে পুড়ে যে ৪১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তঁাদের অনেকের অবস্থা গুরুতর। আমরা নিহতদের জন্য গভীর শোক এবং আহত ব্যক্তিদের জন্য আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।
এ কথা অনুমান করা কঠিন নয় যে সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত ব্যর্থতা, দায়িত্বহীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বারবার এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ও আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই মৃত্যু জবাবহীন। আবাসিক এলাকার একটি নিয়মকানুন আছে, সড়ক ও ভবন নির্মাণের জন্যও রয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন। এখানে সেই আইন পদে পদে অগ্রাহ্য করা হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চকবাজারের যে চারতলা ভবনটি থেকে আগুনের উৎপত্তি, সেই ভবনের মালিক সেটি ভাড়া দিয়েছেন রাসায়নিক পদার্থ, স্প্রের কৌটা ও প্লাস্টিকের গুদাম হিসেবে। শুধু এই ভবনই নয়, পুরান ঢাকার অনেক স্থানেই এ ধরনের বিপজ্জনক পদার্থের বহু গুদাম রয়েছে। একই ভবনে গুদাম ও মানুষের বাসস্থান।
২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিক পদার্থের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের কারণেই তা এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঠিক কীভাবে হয়েছিল, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সেখানে দাহ্য পদার্থের গুদাম থাকায় অতি দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করে। রাত সোয়া ১০টার দিকে যখন আগুনের সূচনা ঘটে, তখন সেখানে ছিল প্রচণ্ড যানজট। মোটরগাড়ি, ভ্যান, মোটরসাইকেল, রিকশাভ্যান, রিকশা ইত্যাদি একটির সঙ্গে আরেকটি গায়ে গায়ে লাগা ছিল। সড়কটি এতই সরু যে এর এক পাশের ভবন থেকে আগুন আরেক পাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
সব মিলিয়ে পুরান ঢাকা পরিণত হয়েছে এক মৃত্যুপুরীতে। সেখানকার বাসিন্দারা নিয়ত ভীতি-আতঙ্কের মধ্যে থাকলেও বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত কর্তাব্যক্তিরা কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। দুর্ঘটনা ঘটনার পর আমরা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নড়াচড়া দেখি। মন্ত্রী-সাংসদ–মেয়রদের নানা আদেশ–উপদেশের কথা শুনি। বুধবারের আগুন লাগার পরও তদন্ত কমিটি হয়েছে, তদন্ত অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে।
৯ বছর আগে নিমতলীর ঘটনার পর সরকার গঠিত কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল; যার মধ্যে ছিল পুরান ঢাকার ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে ফেলা। এরপর তৎকালীন শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটি গঠন পর্যন্তই শেষ। নিমতলীর ঘটনার পর গুদাম সরানো নিয়ে কিছুদিন লোক দেখানো তৎপরতা চললেও পরবর্তী সময়ে সবকিছু হিমাগারে চলে যায়। মন্ত্রী চলে গেছেন, গুদাম কারখানা ঠিকই রয়ে গেছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশন বলেছে, অগ্নিদগ্ধ ভবনসহ আবাসিক এলাকায় কোনো ভবনেই গুদাম করার বা কারখানা স্থাপনের অনুমতি তারা দেয়নি। অর্থাৎ সেখানে স্থাপিত সব গুদামই অবৈধ। তাহলে সেই গুদামগুলো কেন সরানো হলো না? চকবাজারের আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই রিপোর্ট দেবে, সুপারিশ করবে। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা দুর্ঘটনার কারণগুলো দূর করার নিশ্চয়তা আদৌ পাওয়া যাবে কি?
দুর্ঘটনায় আমরা যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে কারণ খুঁজে বের করে সেটি দূর করতে পারলে পরবর্তী দুর্ঘটনা ও লাশের মিছিল থামানো যাবে। আশা করি, এবার কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙবে।