খ্রিষ্টীয় নববর্ষের প্রথম দিনটিতে বাংলাদেশে আট হাজারের বেশি নবজাতক পৃথিবীর আলো দেখেছে। কিন্তু মর্মান্তিক হলো, এটা নিশ্চিত দিনপঞ্জির পাতায় ২৯ জানুয়ারি তারিখটি আসার আগেই প্রায় আড়াই শ শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আশঙ্কায় থাকবে। এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাগত একটি ভগ্নচিত্র। নীতিনির্ধারকদের তথ্যটি খুব ভালোভাবেই জানা আছে। কিন্তু এই মলিন চিত্র বদলে দিতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের তেমন সংবেদনশীলতা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ইউনিসেফ যথার্থই বলেছে, অপরিপক্ব অবস্থায় জন্মানো ও প্রসবকালীন জটিলতায় এসব শিশু মারা যাচ্ছে।
শিশুমৃত্যুর হার রোধে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ববাসীর কাছে সুবিদিত। অতীতে ধারাবাহিকভাবে এক বছর বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমে এলেও গত পাঁচ বছরে তা থেমে আছে। সুখের বিষয়, নবজাতকের অকালমৃত্যুর কারণ ও প্রতিকার নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত। অথচ তা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মনোযোগের ক্ষেত্রে ঔদাসীন্য রয়েছে। এর বড় প্রমাণ ক্যাঙারু মাদার কেয়ার কর্মসূচিকে সম্পূর্ণতা না দেওয়া। সরকারই ঠিক করেছিল, এ রকম ২ হাজারটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র সারা দেশে জরুরি ভিত্তিতে দরকার। কিন্তু বাস্তবে তা রয়েছে প্রায় ১০০।
নবজাতকের মৃত্যু রোধে প্রধান করণীয় হলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব ঘটানো এবং তা করাতে হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা। থাকতে হবে প্রয়োজনীয় উপকরণও। অথচ এখনো প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু জন্ম নিচ্ছে বাড়িতে।
তিনটি মূল কারণে নবজাতকের মৃত্যুর হার কমছে না বলে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, বার্থ এক্সপেকশিয়া বা এককালীন শ্বাস জটিলতা। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে অনেক বাচ্চা নিজে শ্বাস নিতে পারে না। তখন তাদের অক্সিজেন মাস্কের দরকার পড়ে। বাড়িতে জন্ম নেওয়া শিশুকে মাস্ক দেওয়া সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, নিউমোনিয়া ধরনের কিছু সংক্রমণ, যাকে বলে সেপসিস। তৃতীয়ত, জন্মকালে ওজন কম থাকা। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে সংখ্যক প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন, দেশে তা নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রও আছে প্রয়োজনের তুলনায় কম।
সুতরাং এই সমস্যার সমাধান হলো, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোসহ নবজাতকের মা-বাবাদের সচেতন করা। দেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতাও
গুরুতর। যেখানে বাল্যবিবাহ, সেখানেই নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বড় উদ্বেগের কারণ থাকে।
আমরা মনে করি, সরকারকে অবশ্যই ক্যাঙারু মাদার কেয়ার কর্মসূচির আওতায় অবিলম্বে প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করে দিতে হবে। যেহেতু দাতাগোষ্ঠী ধীরে ধীরে এ ধরনের সেবাদান থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে, তাই কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এ খাতে নিজ তহবিল থেকে অর্থায়ন করা। অবকাঠামোগত বহু ক্ষেত্রেই মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে। তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু নবজাতকের অকালমৃত্যু রোধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিত বলে মনে করি।