আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশের সব নদ-নদীর তালিকা, বিভাগওয়ারি দখলদারদের তালিকা ও নদী দখলমুক্ত করতে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। গত রোববার বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও কামরুল হোসেন মোল্লার দ্বৈত বেঞ্চ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের শুনানিকালে এসব নির্দেশনা দেন। আমরা উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনাকে স্বাগত জানাই।
রিটে উত্থাপিত তথ্যে বলা হয়েছে, নদীর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে গরমিল আছে। নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী নদীর সংখ্যা ৭৭০-এর বেশি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে মোট নদী আছে ৪৯৬টি। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ-নদী পুস্তিকায় ৪০৫টি নদীর পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যদিকে ম. ইনামুল হকের গবেষণায় ১ হাজার ১৮২টি নদীর উল্লেখ আছে।
নদী নিয়ে উচ্চ আদালত এর আগেও বহুবার নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এক মামলার রায়ে দেশের সব নদ-নদী রক্ষায় সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন হাইকোর্ট। তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা’ উল্লেখ করে আদালত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সব নদ-নদীর অভিভাবক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সেই সঙ্গে নদীদূষণ ও দখলমুক্ত করতে ১৭টি নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু নদী কমিশন কি অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন? ক্ষমতাধর অনেক ব্যক্তি নদী কমিশনের কর্তৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করছেন। সে ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় ভূমিকা ছাড়া নদী কমিশনের পক্ষেও অর্পিত দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।
নদী রক্ষায় হাইকোর্টের ওই রায়ে নদী সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ে একটি আলাদা অধ্যায় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। দেশের প্রতিটি কলকারখানার শ্রমিকদের মধ্যে নদীবিষয়ক সচেতনতা তৈরির কথাও বলা হয়েছিল। প্রায় তিন বছর আগে উচ্চ আদালত এ রায় দিলেও নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ কী পদক্ষেপ নিয়েছে? নিলে নদীর সংখ্যা জানতে নতুন করে রিট করার প্রয়োজন হতো না। যেখানে নদীর সংখ্যা কত সে বিষয়ে সরকারের কাছে সঠিক তথ্য নেই, সেখানে তারা নদী রক্ষায় পদক্ষেপ নেবে কীভাবে? দখলদারদের দৌরাত্ম্যে অনেক নদী-খাল ও জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। নদীর সংখ্যা সঠিক না হওয়ায় দখলদারের সংখ্যাও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা রক্ষায় উচ্চ আদালত থেকে একাধিকবার নির্দেশনা দেওয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের নদীগুলোর পানি অতিরিক্ত লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পানির চাহিদা মেটাতে নদীগুলো রক্ষা করতেই হবে। নদীকে হত্যা করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নয়। বরং নদীকে রক্ষা করলেই দেশের উন্নয়ন টেকসই হবে, মানুষের জীবনধারা নির্বিঘ্ন হবে। উচ্চ আদালত তুরাগকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিলেও সব নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে গণ্য করে তাদের রক্ষায় কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশ্ন হলো হাইকোর্টের নির্দেশনার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের ঘুম ভাঙবে কি?