সরকার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থেও কখনো কখনো আইন করে থাকে। কিন্তু বৃহত্তর জনগণের স্বার্থে যে আইন করা জরুরি, সেটা বছরের পর বছর ফেলে রাখতেও তাদের বাধে না। ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, নতুন আয়কর আইন করা হবে। তিনি একনাগাড়ে ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দুটি বাজেট পেশ করেছেন। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, আয়কর আইন যুগোপযোগী করে ব্যবসা ও উন্নয়নবান্ধব করার লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রশ্ন হলো একটি যুগোপযোগী, ব্যবসাবন্ধব ও উন্নয়ন–সহায়ক আইন করতে কত বছর সময় লাগে। আইনের খসড়া তৈরির দায়িত্ব যাদের, সেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১১ বছর পর এসে বলছে, চলতি মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২০) আইনের খসড়া চূড়ান্ত হবে। এনবিআর খসড়া চূড়ান্ত করলে সেটি আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে মন্ত্রিপরিষদ সভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময়ক্ষেপণের কারণ কী? এনবিআরের কর্তাব্যক্তিরা কি নতুন আয়কর আইন প্রণয়নের বিষয়ে আন্তরিক নন? পুরোনো আইনে কি তাঁদের সুবিধা হচ্ছে? ২২ লাখ আয়করদাতার মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক অনলাইনে আয়কর দিচ্ছেন; বাকিরা তা করছেন সনাতন পদ্ধতিতে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশের এ যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে আয়কর প্রদান ও গ্রহণের সনাতন পদ্ধতি খাপ খায় না। বর্তমানে ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ দিয়ে দেশের কর খাত চলছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এটি অবশ্যই যুগোপযোগী ও আয়করদাতাবান্ধব করতে হবে। প্রয়োজনে আয়কর পরিশোধের প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে, যাতে মানুষ ঘরে বসেই আয়কর দিতে পারেন।
আয়কর আইনের সংস্কার না হওয়াই এনবিআরের একমাত্র সমস্যা নয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নতুন কাস্টমস
আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই আইনও সংসদে পাস হয়নি। বর্তমানে ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলছে। ৫১ বছর আগের আইন দিয়ে কেন এনবিআরকে চলতে হবে, তা বোধগম্য নয়। অন্যদিকে ২০১২ সালে ভ্যাট আইন প্রণীত হলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে প্রায় অর্ধযুগ বাস্তবায়িত হয়নি; ২০১৯ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়।
অর্থনীতির আকার যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে করদাতা বাড়ছে না বলে বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৪ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএনধারী) বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন। দীর্ঘ ১০ বছরে রিটার্ন জমাদানকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২২ লাখে। কিন্তু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর সংখ্যা ৪২ লাখ। অথচ এই সময়ে অর্থনীতির আকার বেড়েছে কয়েক গুণ। সব মিলিয়ে ১০ বছরে রাজস্ব খাতে বড় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার হয়নি। ভ্যাট আইন চালু হলেও অনেক ক্ষেত্রে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন যে পুরোনো আইন ও ব্যবস্থাপনা দিয়ে বিশাল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। নতুন ও যুগোপযোগী আইন প্রয়োজন।
শুধু আইনগত ত্রুটি নয়, এনবিআরের কাঠামোগত দুর্বলতাও প্রকট। বর্তমানে জেলা পর্যায়ে এনবিআরের কার্যালয় আছে। ফলে উপজেলা পর্যায়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আয়করের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। উপজেলা পর্যায়ে এনবিআর কার্যালয় থাকা জরুরি। আর অনলাইনে আয়কর ও ভ্যাট দেওয়া পুরোপুরি চালু হলে লোকবল বেশি বাড়াতে হবে না। সব মিলিয়ে, এনবিআরের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব ব্যবসায়ীবান্ধব নতুন আয়কর আইন ও কাস্টমস আইন চালু করা হোক।