৭ সেপ্টেম্বর তিন ঘণ্টা শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে রেখেছিলেন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর প্রত্যাশী তরুণেরা। এই অবরোধের কারণে কেবল শাহবাগ মোড় নয়, পুরো ঢাকা শহরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এর এক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও এলাকায় ৬ ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এতে পুরো শহরই হয়ে পড়ে স্থবির।
দেড় কোটি জন-অধ্যুষিত ঢাকা শহরে যানবাহনের তুলনায় সড়কের আয়তন কম। একটি আধুনিক শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু রাখার জন্য অন্তত ২৫ শতাংশ রাস্তা প্রয়োজন হয়। ঢাকায় রাস্তা আছে ৯ শতাংশ। তদুপরি বেহাল গণপরিবহনের কারণে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি।
এ অবস্থায় আন্দোলন তথা অবরোধের কারণে কোনো সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলে সারা শহরের জনজীবন অসহনীয় হয়ে পড়ে। দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে সরে না এলে জনদুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে। যেকোনো দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধের চেয়ে উচিত যৌক্তিক পথ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা তুলে ধরা। বর্তমানে দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। যৌক্তিক যেকোনো দাবি তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে, এমন একটি আশাবাদ তৈরি হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচিত ছিল তাঁদের দাবিদাওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ করে বড় বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশ করা নিয়মিত ঘটনা ছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ দাবি আদায় করতে সড়ক অবরোধ ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েছেন। সরকার সচিবালয়কে কেন্দ্র করে সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ চলছেই।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন, তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া, লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসংগতভাবে যা কিছু করার, আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু আমাদের ঘেরাও করে কাজে বাধা দেবেন না।’ এ ছাড়া সড়ক অবরোধ, সড়কে মিছিল, মানববন্ধন না করার জন্য একাধিকবার পরিপত্রও জারি করা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের দমবন্ধ অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে, জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এর অর্থ এই নয় যে এক মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দাবির পাহাড় চাপিয়ে দিতে হবে। দাবি আদায়ের নামে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত করতে হবে।
যেকোনো জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করি। কিন্তু সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যেমন সময় দিতে হবে, তেমনি আন্দোলনের নামে জনগণকে কষ্ট দেওয়া বা জনজীবনকে অচল করা যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের যে মূল কাজ—রাষ্ট্র সংস্কার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, সে জন্য তো তাদের সময় দিতে হবে।
আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে কোনো সংগঠন বা সম্প্রদায় দাবি আদায়ের জন্য অবরোধ ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি নেবে না। আর এই দাবি আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে, সেটা হলো আলোচনা, স্মারকলিপি প্রদান। সরকারও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সেল গঠন করতে পারে, যাঁরা দাবি উত্থাপনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। কোনোভাবে ঘেরাও বা সড়ক অবরোধ দাবি আদায়ের মাধ্যম হতে পারে না।