দখলদারদের কবলে বনভূমি

সম্পাদকীয়

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বন বিভাগ বনভূমি দখলের যে হিসাব দিয়েছে, তা উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হবে। তাদের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে বনের জমি জবরদখলকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ এবং তাঁদের দখলে আছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি। মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর।

বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বন দখল করে স্থায়ী স্থাপনাসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা করেছেন ১৭২ জন। তাঁদের দখলে আছে ৮২০ একর সংরক্ষিত বন। হাটবাজার, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কটেজ, ফার্ম, রিসোর্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার নামে ৪ হাজার ৯১৪ একর বন দখল করা হয়েছে।

এর আগে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশের একটি যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছিল, এক যুগে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন ধরনের বনভূমি কমেছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৬ হেক্টর। দখলদারি অব্যাহত আছে টাঙ্গাইলের মধুপুর, গাজীপুরের শালবাগানসহ বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চলে।

আমরা সংসদীয় কমিটির উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। বিলম্বে হলেও বেদখল হওয়া বনভূমির একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তারা দিয়েছে। এখন বন বিভাগ তথা সরকার কী করে, তা দেখার বিষয়। কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, দখল করা বনের মধ্যে ৫০০ একরের মতো জমি উদ্ধার করা হয়েছে। সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ নাগাদ দখল হওয়া জমির বড় একটি অংশ উদ্ধার করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সাবের হোসেন চৌধুরীর এই আশাবাদের ভিত্তি কী। জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া কিংবা দু-একটি মামলার মধ্যে বন বিভাগের কার্যক্রম সীমিত থাকলে কখনো বেদখল হওয়া বনভূমি উদ্ধার করা যাবে না। দখলদারেরা এতটাই প্রভাবশালী যে এসব মামলা বছরের পর বছর নিষ্পত্তি হয় না। দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধার করতে প্রয়োজন সমন্বিত ও টেকসই পরিকল্পনা।

বন সংরক্ষণে দেশে কঠোর আইন আছে। তারপরও আড়াই লাখের বেশি একর বনভূমি কীভাবে উজাড় হলো, কারা এর পেছনে আছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বেদখল হওয়া বনের জমি উদ্ধারে বন ও ভূমি মন্ত্রণালয় ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। কেবল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করলেই হবে না, দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধারে তাদের সক্রিয়তা থাকতে হবে।

পরিবেশবিদদের মতে, যেকোনো দেশে অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। আমাদের আছে মাত্র ১৫ শতাংশ, যার মধ্যে প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ খুবই কম, ৫ শতাংশের মতো। সৃজন বনের পরিমাণ বাড়লেও সংরক্ষিত বা প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাওয়া বনভূমি উদ্ধার করা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু যেসব বনভূমি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে গেছে, সেগুলো উদ্ধার করতে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, বনভূমির মালিক জনগণ। সরকারের দায়িত্ব সেই বনভূমি রক্ষা করা। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বনভূমি সংরক্ষণ অগ্রাধিকারে থাকতে হবে।