তাঁর বিরল গুণাবলি হোক আমাদের পাথেয়

সম্পাদকীয়

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুসংবাদটি আমাদের যেমন শোকাহত করে, তেমনি আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। আমরা কি সত্যিই এই গুণী মানুষকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছি? আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি গণতন্ত্র উত্তরণে তঁার অসামান্য অবদানকে স্বীকার করেছে, না সবকিছু দলীয় দৃষ্টিতে দেখেছে?

নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনাশাসক এরশাদের পতনের পর আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং তঁার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারই দেশে প্রথমবারের মতো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। পদের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যত দ্রুত সম্ভব নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে তাঁকে তাঁর সাবেক কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে এবং সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি তখনো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সেই সরকারের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। আবার দলীয় সরকারের অনেক অন্যায় সিদ্ধান্ত তিনি মানতে পারেননি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন আওয়ামী লীগের অনুরোধে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পাঁচ বছর তঁার বড় ধরনের মতপার্থক্য হয়নি। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিরোধ বাধে এবং নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য তারা তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তাঁকেও দায়ী করা হয়। একজন ন্যায়বান মানুষের কাছে এটি ছিল আঘাত।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮০ সালে তিনি আপিল বিভাগে বিচারকের দায়িত্ব পান এবং ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন অষ্টম সংশোধনীসংক্রান্ত মামলার রায় প্রদানকারী অন্যতম বিচারক। এ রায়ের মাধ্যমে সামরিক সরকার যে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ গঠন করেছিল, তা অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি পদে একাধিকবার অধিষ্ঠিত ছিলেন, যা আমাদের ইতিহাসে দ্বিতীয় কারও ক্ষেত্রে ঘটেনি। তিনি যা সত্য মনে করতেন, অকপটে বলতেন। অনেক সময় লিখিত ভাষণের বাইরে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিতেন। নিজের ক্ষমতার বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘মিলাদ পড়া ও কবর জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো কাজ নেই।’

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে পদ কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশ ও মানুষ। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়; বঙ্গভবনে অতিথি আপ্যায়নে পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতিদের আমলে যে বরাদ্দ ছিল, তিনি তা কয়েক গুণ কমিয়ে এনেছিলেন। মনে করতেন, জনগণের অর্থ যথেচ্ছ খরচ করার অধিকার তঁার নেই।

২০০১ সালের নভেম্বরে মেয়াদ শেষে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর থেকে তিনি একধরনের স্বেচ্ছাবন্দী জীবন কাটান। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে তাঁকে দেখা যেত না।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তঁার বিরল গুণাবলি হোক আমাদের পথের পাথেয়।