ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম শুরু হয়েছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস সেন্টারের সূত্রে জানা গেছে, ১৮ জুন এক দিনেই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৩১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তার পরের দিন এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৬। জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু হাসপাতাল–ক্লিনিকে ভর্তি হয়নি এবং জ্বর শনাক্ত হয়নি, এমন লোকজনের হিসাব কোনো সংস্থার কাছে থাকার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু বর্ষা শুরু হয়েছে এবং এটা ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম, সেহেতু এই জ্বরে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হতে পারে, এমন আশঙ্কা বাস্তবসম্মত। তাই ডেঙ্গু জ্বর এড়ানোর জন্য সতর্কতা এবং এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। ডেঙ্গু জ্বর বেশ যন্ত্রণাদায়ক, তা স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ ঘটায় এবং সময়মতো সুচিকিৎসার অভাব ঘটলে এই জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহন করে এডিস মশা। এই জাতের মশা নালা–নর্দমার নোংরা পানিতে জন্মায় না, বরং জন্মায় মানুষের গৃহের ভেতরে ও আশপাশে জমে থাকা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে। ছাদে ও বারান্দায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে; গাছের টব, ডাবের খোসা ইত্যাদি আধারে জমে থাকা পানিতে। বর্ষাকালে প্রায়ই থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে থাকে এবং এটাকেই ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে জুন থেকেই শুরু হয় ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ঋতু।
তবে দেখা যাচ্ছে, বছরের অন্যান্য সময়েও লোকজন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস সেন্টারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬৬২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং এটাকে সারা বছরের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন।
এই রোগ সংক্রমণ ও বিস্তারের প্রকৃতি লক্ষ করলে এটা এড়ানোর কিছু উপায় আমরা সহজেই অবলম্বন করতে পারি। সেটা হলো বাসাবাড়ির ভেতরে ও আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া, যাতে এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকানো যায়। দ্বিতীয়ত, মশার কামড় এড়ানোর জন্য সতর্ক থাকা, বাসা মশামুক্ত রাখার চেষ্টা করা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা। বিশেষভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন শিশুদের ব্যাপারে। তাদের খালি গায়ে না রাখা, কেননা এডিস মশা সাধারণত শরীরের উন্মুক্ত অংশে বসে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও বিশেষভাবে প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব প্রতিটি পাড়া–মহল্লায় নিয়মিত মশা নিধন অভিযান পরিচালনা করা। প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই গত মার্চে ঢাকার উভয় সিটি করপোরেশনে জরিপ চালিয়ে বেশ কিছু এলাকায় এডিস মশার ঘনত্বের সূচক বেশি পাওয়া গেছে; জুন মাসে তা আরও বেড়েছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুতরাং সেসব এলাকায় এডিস মশা নিধনের জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন। গাছের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, বালতি, পানির চৌবাচ্চা ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও কিছু মানুষ এই জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন; এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক দায়িত্ব হলো আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত রোগ শনাক্ত করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দ্রুত ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণের বিশেষ সরঞ্জাম বিতরণ করা হয়েছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য একটা জাতীয় গাইডলাইনও রয়েছে। নাগরিকদের সতর্কতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারি–বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিক দায়িত্বশীলতা থাকলে ডেঙ্গু জ্বর মোকাবিলা করা কঠিন হবে না বলে আমাদের প্রত্যাশা।