ভাব থেকে ভাষার জন্ম। সুবিধাভোগী সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাব আর সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যালঘু জনজাতির ভাব আলাদা। তাই তাদের ভাষাও আলাদা। সংখ্যাগুরুর ভাষা নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণা হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সাধারণত অবহেলিত থেকে যায়। আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও কৌম সমাজে এমন অনেক ভাষা আছে, যার কোনো লেখ্য রূপ নেই। অক্ষর নেই। কিন্তু মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে। কালের বিবর্তনে এসব ভাষার নীরব মৃত্যু হয়।
যিনি ভাষার ঐতিহ্যিক ও সামাজিক মূল্য উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর কাছে একটি ভাষার অবলুপ্তি কালের গলিত গর্ভে একটি মহামূল্যবান ইতিহাসের অন্যায্য অন্তর্ধান। সেই ভাষা সংবেদনশীল মানুষ তখন একান্ত আত্মিক দায়বদ্ধতা থেকে বিলীয়মান ভাষাকে আগলে রাখার দুর্নিবার চেষ্টা করতে থাকেন। তেমনই একজন ভাষা সংবেদনশীল গবেষক বান্দরবানের রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক জুয়েল বড়ুয়া। তিনি একজন বাঙালি হয়েও নিজ উদ্যোগে মারমা ভাষা শিখে ‘মারমা-বাংলা ভাষা’র একটি অভিধান সংকলন করেছেন। এর ফলে মারমা ভাষার শব্দকোষ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকখানি দূরীভূত হয়েছে।
গত শুক্রবার বান্দরবানে মারমা-বাংলা ভাষার প্রথম অভিধানটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। জেলা শহরের মারমা বাজার এলাকার একটি হোটেলের মিলনায়তনে শিক্ষাবিদ ক্য শৈ প্রু মারমা অভিধানটির মোড়ক উন্মোচন করেন। মারমা-বাংলা অভিধানের সংকলক জুয়েল বড়ুয়ার মাতৃভাষা বাংলা হলেও তিনি মারমা ভাষা এবং বর্ণমালা শিখে স্ব-উদ্যোগে পড়াশোনা করে নিয়েছেন। অভিধানে মারমা ভাষার শব্দগুলো মারমা ও বাংলা বর্ণে লেখা হয়েছে। এরপর সব মারমা শব্দের বাংলায় অর্থ দেওয়া হয়েছে। অন্য ভাষার যাঁরা মারমা ভাষা শিখতে আগ্রহী, তাঁরা খুব সহজে ভাষাটি শিখতে পারবেন।
তিন পার্বত্য জেলায়, ভারত ও মিয়ানমারে মারমা জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় পৌনে দুই লাখ মারমা আছে। কিন্তু এত দিন মারমা ভাষার অভিধান সংকলন করা হয়নি। লক্ষ করার বিষয় হলো, একজন ব্যক্তির উদ্যোগে একটি ভাষার শব্দকোষ সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ যদি রাষ্ট্র নেয়, তাহলে কোনো জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাবে না। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রত্যেক জনজাতির ভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে রেহাই পাবে।