গত রোববার চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় গ্যাস বিস্ফোরণে সাতজন মানুষের মৃত্যু যেমন মর্মান্তিক, তেমনি সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতারও প্রমাণ। একের পর এক গ্যাস দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, তারপরও কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। গ্যাসের মতো অতি দাহ্য পদার্থের সঞ্চালন, সরবরাহ লাইনও সংযোগ হতে হয় শতভাগ টেকসই, নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত। এর কোনো পর্যায়ে সামান্য ত্রুটি থাকলে তার পরিণাম যে ভয়াবহ হয়, চট্টগ্রামের পাথরঘাটার বাড়ির বিস্ফোরণই একমাত্র উদাহরণ নয়। শুধু চট্টগ্রামেই ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৭ নভেম্বর সংঘটিত পাঁচটি বিস্ফোরণে মারা গেছে ১২ জন। আহত হয়েছে অনেকে। প্রাণঘাতী গ্যাস দুর্ঘটনা শুধু চট্টগ্রামেই ঘটেছে তা নয়; রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই এ দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। বছরওয়ারি হিসাবে দেখা যায়, গ্যাস দুর্ঘটনায় ২০১৬ সালে ৪ জন, ২০১৭ সালে ৫ জন, ২০১৮ সালে ১৯ জন এবং চলতি বছরে ৩২ জন মারা গেছে। কখনো ত্রুটিপূর্ণ লাইনের কারণে, কখনো ব্যবহারকারীদের অসাবধানতায়।
পাথরঘাটার দুর্ঘটনার পর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্যাসের পাইপলাইন ও রাইজার থেকে কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কর্মকর্তাদের মতে, দুর্ঘটনাকবলিত ভবনের নিচের সেপটিক ট্যাংক থেকে বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে। কেননা, ভবনটি নকশা মেনে করা হয়নি। আবার আহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ বলেছেন, নিচের তলার কোনো ঘরে দেশলাইয়ের কাঠি থেকেও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে জেলা প্রশাসন, কেজিডিসিএল ও সিডিএর উদ্যোগে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরনের তদন্ত কমিটির প্রতি মানুষের আস্থা কম। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কমিটি সত্য উদ্ঘাটনের চেয়ে সত্য আড়াল করতে ব্যস্ত থাকে। তারপরও আমরা আশা করতে চাই, অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। দুর্ঘটনার পরই কেজিডিসিএল রাইজার পরীক্ষার কাজ শুরু করেছে। এটি অনেকটা রোগী মারা যাওয়ার পর বাড়িতে ডাক্তার আসার মতো। আগে কেন তারা রাইজার পরীক্ষার কাজটি করল না? একই কথা প্রযোজ্য সিডিএর ক্ষেত্রেও। তারা বলছে, ভবনটি নকশা মেনে করা হয়নি এবং নিচের অনিরাপদ সেপটিক ট্যাংক থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে? তারাই–বা কেন ভবনমালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিল না?
আমরা আশা করি, গ্যাস বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি সময়মতো প্রতিবেদন জমা দেবে এবং সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেও কর্তৃপক্ষ পিছপা হবে না। বাড়ির মালিকের আইন লঙ্ঘন কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা—যে কারণেই গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটুক না কেন, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় আরও বড় দুর্ঘটনা এবং সেখানে আরও বেশি মৃত্যুর আশঙ্কা থেকেই যাবে।
পত্রিকান্তরের খবরে বলা হয়, রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে যে গ্যাস সরবরাহ লাইন সম্প্রসারিত হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। খোদ রাজধানীতে অর্ধশত বছরের পুরোনো লাইনও রয়েছে। গ্যাস দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অবৈধ সংযোগ। ২০১০ সাল থেকে আবাসিক ভবনে নতুন করে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকার কথা থাকলেও একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয়, যা অত্যন্ত নড়বড়ে ও ত্রুটিপূর্ণ। এসব লাইন থেকে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। মাস কয়েক আগে ঢাকার রূপনগর বস্তি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তারও কারণ এই অবৈধ গ্যাস–সংযোগ। অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস–সংযোগকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হোক।