গাছে বেঁধে রাখায় আত্মহত্যা

আত্মহত্যার প্ররোচনার অর্থ এমন পরিস্থিতি সচেতনভাবে সৃষ্টি করা, যা পীড়িত মানুষটির সামনে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই অবশিষ্ট রাখে না। অতি উদ্বেগের কথা, প্রতিনিয়তই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির নতুন নতুন নজির হাজির হচ্ছে। নিদারুণ অপমানের শিকার হয়ে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে বহু মানুষকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে দেখা যাচ্ছে।

এই একুশ শতকেও এ দেশে নারীকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করার ঘটনা খুব একটা বিরল কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের নির্যাতনের অনেক ভিডিও চিত্র ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বড় বিহানালী ইউনিয়নের বাগান্না গ্রামে আক্তারুন নেছা নামের দুই সন্তানের জননীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে একজন ইউপি সদস্য নির্যাতন করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পরে এসে তাঁকে উদ্ধার করেছেন। এই অপমান হজম করতে না পেরে পরদিন বুধবার তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।

অতি বিস্ময়সূচক খবর হলো অভিযুক্ত ইউপি সদস্য আবদুল মজিদ ঘটনার পরপরই আক্তারুন নেছাকে গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে রাখার কথা স্বীকার করলেও নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তিনি আক্তারুন নেছাকে বেঁধে রাখলেও মারধর করেননি। অর্থাৎ তাঁর বিবেচনায় একজন নারীকে বেঁধে রাখাটা নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে না। আক্তারুন নেছাকে বেঁধে রাখার কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, আক্তারুন নেছা তাঁর ফসল নষ্ট করেছিলেন। এ কারণে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে আবদুল মজিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিচারে হয়তো তাঁর আইনানুগ সাজাও হবে। কিন্তু ভয়ের বিষয় হলো মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় একজন নারীকে বেঁধে রাখা যে মহা অপরাধ ও গর্হিত কাজ, সেটি তিনি একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও উপলব্ধি করতে পারেননি। ভয়ের বিষয় এ কারণে যে আবদুল মজিদ কোনো একক সত্তা নয়। অজস্র আবদুল মজিদ এ সমাজে রয়েছেন। তাঁদের উপলব্ধিতে পরিবর্তন না এলে তাঁরা আগের মতোই যথার্থ কর্তব্যজ্ঞানে আক্তারুন নেছাদের ধরে ধরে গাছে ঝুলিয়ে পেটাতে থাকবেন এবং কেবল এসব নারী আত্মহত্যা করার পরই ‘নিজস্ব গতি’ অনুযায়ী আইন তাঁদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবে। পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয় তাই হতে থাকবে, অর্থাৎ আবদুল মজিদেরা নিরপরাধ সাব্যস্ত হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন। অর্থাৎ শুধু আইন দিয়ে পরোক্ষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া থেকে আক্তারুন নেছাদের রক্ষা করা যাবে না।

রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, নারী নির্যাতন যে জঘন্য অন্যায়, সেই বোধ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে আক্তারুন নেছাদের নয়, বরং আবদুল মজিদদেরই সামাজিকভাবে সম্মান হারাতে হবে। সেই সম্মানহানির ভয়কে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাতে যদি আক্তারুন নেছারা অন্তত প্রাণে বাঁচতে পারেন।