বাংলাদেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর সভাপতি পদটা আজও আলংকারিক হয়ে আছে। বেশির ভাগ সভাপতিই ফেডারেশনে আসেন না। কোথায় কী হচ্ছে, সেই খবরও তাঁরা তেমন রাখেন না। তিন বা ছয় মাসে একটা সভা হলেও অনেকেই ফেডারেশনমুখী হন না। ক্রীড়া ফেডারেশনের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্ব কতটা পালন করেন সভাপতিরা, সেই প্রশ্ন জোরালোভাবেই উঠছে। প্রথম আলোর খেলার পাতায় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর সভাপতিদের নিয়ে ছাপা হওয়া ধারাবাহিক প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য তা মোটেও সুখকর নয়। দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ৩৭টি ক্রীড়া ফেডারেশনের বেশির ভাগ সভাপতিই নিষ্ক্রিয় এবং উদ্যোগহীন। তাঁরা খেলার সঙ্গে সম্পর্কহীন।
সাধারণত পৃষ্ঠপোষক আনতে পারেন এমন সরকারি-বেসরকারি শীর্ষ ব্যক্তি, ব্যবসায়ীসহ নানা অঙ্গনের মানুষকে ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি পদে নিয়োগ দেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সেটিও রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে। কিন্তু ওই ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট খেলাটির সঙ্গে পরিচিত কি না, খেলার উন্নয়নে কাজ করতে উৎসাহী কি না, এসব যেন একেবারেই গৌণ। অতীতে শুধু অনুরোধে ঢেঁকি গিলে অনেকেই বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছেন। খেলাকে এগিয়ে নিতে তাঁরা তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। আর সভাপতিদের সবাই পৃষ্ঠপোষক আনতে পারেন, বিষয়টি এমনও নয়। সভাপতি পৃষ্ঠপোষক এনে দেবেন, এই আশায় তীর্থের কাকের মতো সারা বছর অপেক্ষায় থাকে কোনো কোনো ফেডারেশন।
ক্রীড়া ফেডারেশনে কোন ধরনের সভাপতি এসেছেন, তা বোঝার জন্য একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। অতীতে এমন সভাপতিও এসেছেন, যিনি এক ব্যাংকে গিয়েছিলেন তাঁর ফেডারেশনের জন্য স্পনসরশিপ নিশ্চিত করতে। কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে সেই কথাটিই আর বলা হয়নি। তিনি তাঁর ভাগনের জন্য একটি চাকরির তদবির করেই চলে আসেন। এমন ফেডারেশন ও সভাপতি দিয়ে ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমরা কী আশা করতে পারি?
ক্রীড়া ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটি কাগজ-কলমে হলেও নির্বাচিত। তবে তিন–চারটি ফেডারেশন বাদে বাকিগুলোর সভাপতিরা সরকারের পছন্দে আসেন। সম্মান ও মান-মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রেখে এখন অনেকেই তদবির করেন ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি হতে। কিন্তু ফেডারেশনের পদগুলো যেহেতু অবৈতনিক, তাই জবাবদিহির কোনো সুযোগ নেই। কিছু ব্যতিক্রম বাদে সভাপতিরা খেলার উন্নয়নে নিরাবেগ। সভাপতিদের অনেকেই এখন ক্রীড়াঙ্গনে কিছু দেওয়ার চেয়ে বরং নেওয়ার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। বিদেশ ভ্রমণসহ নানা সুবিধা নেওয়ার জন্য ফাঁকফোকর খোঁজেন অনেক সভাপতি। এ নিয়ে ফেডারেশনে তৈরি হয় নানা দ্বন্দ্ব। এক ক্রীড়া সংগঠকের প্রতিক্রিয়াও পরিস্থিতি বুঝতে সহায়তা করবে। তাঁর মন্তব্য, অনেক সভাপতিই চেহারা দেখাতে আসেন এই অঙ্গনে। ক্যামেরা খোঁজেন। কেউ কেউ নিজের ফেডারেশনের অনুষ্ঠানে আসেন নিজেই অতিথি হয়ে।
মূল সমস্যা হচ্ছে ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি নিয়োগে সরকারের কোনো নীতিমালা নেই। ফলে যাচ্ছেতাই দশা হওয়ার কথা, তা–ই হয়েছে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে। যোগ্য ও যথাযথ ব্যক্তিদের এই পদে আনতে ও অযোগ্যদের ঠেকাতে একটি নীতিমালা তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে যে সরকারি-বেসরকারি শীর্ষ পদের ব্যক্তিদের ক্রীড়াঙ্গনে দেওয়ার মতো সময় নেই। ফলে ক্রীড়া–সংশ্লিষ্টতা আছে এমন ব্যক্তিগতদের যাতে সভাপতি পদে আনা যায়, তেমন নীতিমালা করতে হবে। যাঁদের উৎসাহ আছে, সময় দিতে পারবেন, খেলার উন্নয়নে কাজ করার সামর্থ্য রাখেন এবং খেলাটা নিয়ে ভাবেন, এমন ব্যক্তিদেরই প্রাধান্য দিতে হবে। সভাপতিদের মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকা উচিত। তাঁদের একটা লক্ষ্যও বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন।