এখনই সজাগ না হলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ

সম্পাদকীয়

পরিবেশদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। চলতি সপ্তাহে বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর বাংলাদেশে মারা গেছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৫ জন। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে ভারত শীর্ষে ও বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।

প্রতিবেদনে পরিবেশদূষণকে বিশ্বে রোগ বিস্তারে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিবেশদূষণ হয় প্রধানত আমাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক উপাদান মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ থেকে। এ ছাড়া সিসা, ধূমপান ও কর্মক্ষেত্রে দূষণের শিকার হয়েও অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। বায়ুদূষণে মৃত্যুর দিক থেকেও ভারত শীর্ষে। এরপর যথাক্রমে বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের অবস্থান। অন্যদিকে পানিতে আর্সেনিক সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। পানিতে আর্সেনিকের কারণে ক্যানসার, কিডনিজনিত রোগ, হৃদ্‌রোগ ও স্নায়ুজনিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বায়ু, সিসা ও রাসায়নিক দূষণ রোধের পাশাপাশি দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে, বাড়াতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার। গত ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে ঢাকায় আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আবাসিক প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ অপরিণত নবজাতকের মৃত্যু হয় এবং প্রতি মিনিটে মারা যায় ১৩ জন।

দূষণজনিত মৃত্যুর বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছর দূষণের কারণে যে ৯০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে, তার প্রায় ৭৫ শতাংশই বায়ুদূষণের কারণে। বাংলাদেশেও বায়ুদূষণে মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। পারিপার্শ্বিক বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে ৪৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৫ সালে ছিল ৪২ লাখ। বিপজ্জনক রাসায়নিক দূষণের কারণে ২০০০ সালে মৃত্যুর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ, সেই সংখ্যা ২০১৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে ১৮ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের পাশাপাশি বায়ু, মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। উন্নয়নের নামে বাংলাদেশেও নদী ও বন ধ্বংস করা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। এসব দূষণ কেবল মানুষের মৃত্যুই ঘটাচ্ছে না, যারা বেঁচে আছে, তারাও নানা রোগে ভুগছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু, ডায়রিয়া, ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের উৎসও পরিবেশদূষণ। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, পরিবেশদূষণ করোনার চেয়েও ভয়ংকর।

এ অবস্থায় আমরা যদি এখনই সজাগ না হই, বায়ু, মাটি ও পানিদূষণ পুরোপুরি বন্ধ না করতে পারলেও সহনীয় মাত্রায় না নিয়ে আসতে পারি, তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে এবং পরিবেশদূষণে মৃত্যুর হার আরও বেড়ে যাবে।

ইতিমধ্যে ঢাকা প্রায় বসবাসের অনুপযোগী শহরে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যান্য শহরের পরিবেশও নাজুক অবস্থায় আছে। আর এক দিনও এই ক্ষতি বাড়তে দেওয়া যায় না। আমাদের দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে পরিবেশজনিত যে পুঞ্জীভূত সমস্যা তৈরি হয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে পদক্ষেপ নিলে কোনো কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও সর্বাত্মক কর্মপরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন।