আগামী সাধারণ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল এবং নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে, তা স্বচ্ছ নয়। বরং গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো সত্য ধরে নিলে আমরা বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন হতে পারি। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার কিংবা তার অব্যাহত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে আমাদের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট। বিভিন্ন নির্বাচনে সীমিতভাবে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ে তা ব্যবহারের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এ ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের প্রয়োজন রয়েছে। তেমন কোনো উদ্যোগ না নিয়ে নির্বাচন কমিশনের হুট করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর।
গত পাঁচ সিটি নির্বাচনে সরকারি প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব এবং কারচুপিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের রেশ এখনো মিলিয়ে যায়নি। এ রকম একটি পটভূমিতে নাটকীয়ভাবে ইভিএম চালু করার মতো পদক্ষেপ কীভাবে নিতে পারল, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মতকে সিইসি যেভাবে নেহাত ‘ভিন্নমত’ হিসেবে দেখেছেন, তা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, ইভিএম এমনই একটি মৌলিকভাবে সংবেদনশীল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মতৈক্যের ভিত্তি ছাড়া যার প্রবর্তন হওয়া উচিত নয়। সিইসি যদিও আশ্বস্ত করেছেন যে ‘পরিবেশ যদি অনুকূলে থাকে, তাহলে ব্যবহার করব। ব্যবহার করবই, সে কথা না, প্রস্তুতিমূলক এটা।’ তাঁর এই অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্যকে চালাকিপূর্ণ কৌশল হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
৩৯ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে আসা শতাধিক নির্বাচনী সংস্কারধর্মী সুপারিশের মধ্যে এত দিন একটিও বাস্তবায়নযোগ্য মনে করেনি নির্বাচন কমিশন। এখন হঠাৎ শুধু ইভিএমের মতো একটি সরকারদলীয় প্রস্তাবকে ইসির বেছে নেওয়ার মধ্যে সন্দেহ দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। উপরন্তু নির্বাচন কমিশন নিজেই বলছে, ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। আইনও অনুপস্থিত। অথচ আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ইভিএম প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ঋণপত্র খোলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণের পর প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই পর্যন্ত হয়নি বলেও অভিযোগ আছে। সুতরাং এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ এবং তা সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইনের পরিপন্থী। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইভিএম চালুর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে দাবি করেছেন, এটি প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বে প্রশংসিত। কিন্তু কার্যত এটি এখনো বিশ্বে সর্বজন স্বীকৃত একটি যাচাইকৃত বা পরীক্ষিত ব্যবস্থা নয় এবং সেই হিসেবে স্বীকৃতিও পায়নি। বহু দেশ এই পদ্ধতি চালু করে আবার স্থগিত করেছে। ক্ষমতাসীন দল প্রতিবেশী ভারতকে উদাহরণ হিসেবে হাজির করলেও তা তাদের পক্ষে যাবে না। কারণ, ইভিএম গ্রহণের পরে দুই দশকের বেশি সময় আঞ্চলিক ও স্থানীয় নির্বাচনে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যবহারের পরেই কেবল ভারতের নির্বাচন কমিশন সব দলকে রাজি করানোর পথে হেঁটেছে। আবার সর্বদলীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠারও ছয় বছর পরে ইসি প্রথম লোকসভা নির্বাচনে এটি ব্যবহার করেছে। এরপরও ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সেখানে বিতর্কের অবসান ঘটেনি।
বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য দিনক্ষণ যখন দ্বারপ্রান্তে, জাতীয় রাজনীতিতে যখন নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়েই ন্যূনতম মতৈক্য বা সমঝোতা অনুপস্থিত, প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস এবং হিংসাশ্রয়ী মনোভাব আরও জোরালো হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশন বিভক্ত মতের ভিত্তিতে আরপিও সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে গণতন্ত্রসম্মত বলা যায় না।