রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পেছনে যে কেবল রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, চাঁদাবাজি কিংবা মাদক ব্যবসা জড়িত নয়, সেটাই জানা গেল হত্যার দায়ে আটক চার আসামির জবানবন্দিতে। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহকে হত্যা করার পর থেকেই জল্পনা চলছিল, এর পেছনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি বা আরসা জড়িত।
কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দেওয়া চার আসামি হলেন যথাক্রমে আজিজুল হক, হামিদ হোসেন, নাজিমউদ্দিন ও মো. ইলিয়াস। তাঁরা নিজেদের আরসা সদস্য দাবি করে বলেছেন, সংগঠনের নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
সরকার বিভিন্ন সময় বলে আসছিল যে বাংলাদেশে আরসার কোনো তৎপরতা নেই। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে যে তারা বাংলাদেশে সক্রিয় আছে এবং বিপদ ঘটানোর সামর্থ্যও যে তারা রাখে তার প্রমাণ মিলেছে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। আরসার মতো সংগঠন শুধু রোহিঙ্গা নয়, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও বিপজ্জনক। অভিযুক্তদের জবানবন্দি অনুযায়ী মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে আরসার ২৫ জন সদস্য অংশ নিয়েছেন। তাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশে তঁাদের তৎপরতা জোরালোভাবেই রয়েছে। ২০১৮ সালের জুনে উখিয়ার বালুখালী-২ শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা আরিফউল্লাহ খুনের ঘটনায়ও আরসা জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
উল্লেখ্য, আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফেরার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। এ ছাড়া তিনি শরণার্থীশিবিরে মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে তিনি দেশের ভেতরে সভা-সমাবেশ ও বহির্বিশ্বে জনমত তৈরিতেও ভূমিকা রাখেন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে অংশ দেশে ফেরত যেতে চায় না, বরং এখানে থেকে মাদক ব্যবসা চালাতে আগ্রহী, তারাই মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে, সন্দেহ নেই। গত ১৬ জানুয়ারি আরসা প্রধানের ভাই মো. শাহ আলীকে অস্ত্র, মাদকসহ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। মাদকের পাশাপাশি এখন অবৈধ অস্ত্র রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর চরম অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের আগেও বিভিন্ন সময়ে অত্যাচার নির্যাতনে শিকার হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার চাপ বাংলাদেশকে নিতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নানা সমস্যা বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এখন এসব শিবিরকে কেন্দ্র করে যদি সহিংসতা বা সশস্ত্র তৎপরতা ঘটে, তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকির সৃষ্টি করবে।
আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা শিবিরকে কেন্দ্র করে আরসার তৎপরতার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও শিবিরগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। শিবিরগুলোর নিরাপত্তা জোরদারে সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। আরসা বা এ ধরনের কোনো সংগঠন যাতে এখানে তৎপর হতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে।