মাদকসংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে অসামর্থ্যের পরিচয় দিয়ে চলেছে। একদিকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটন, প্রচলিত আইনের শাস্তি কঠোর করা, মাদক দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়; মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা মামলার সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়ে। অন্যদিকে ইয়াবার বিস্তৃতি অব্যাহত থাকে। ২০০৬ সালে উদ্ধার হয় আড়াই হাজার ইয়াবা বড়ি। এক যুগ পরে তা চার কোটি ছাড়িয়ে যায়।
মাদক নিয়ন্ত্রণে নীতিনির্ধারকদের অনেকেই ‘জিরো টলারেন্স’ কথাটি উচ্চারণে অভ্যস্ত। তাঁদের উচিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (আইএনসিবি) বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো পাঠ করা। ২০১৯ সালের সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টও আগের ধারাবাহিকতায় বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে বাংলাদেশে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এই সংস্থাটির সাম্প্রতিক বছরগুলোর বাংলাদেশবিষয়ক মাদকসংক্রান্ত মন্তব্য পর্যালোচনায় এটা পরিষ্কার যে এই অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহতা নাজুকতর পর্যায়ে পৌঁছেছে।
২০১৮ সালের প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করে, বাংলাদেশে ২০১১ সালের পর মাত্র সাত–আট বছরের ব্যবধানে ইয়াবার উপস্থিতি ৩০ গুণ বেড়েছে। অথচ ইয়াবা, ফেনসিডিল বা হেরোইনের কোনোটিই বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না। সীমান্তের কিছু নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে এগুলো বাংলাদেশে ঢুকছে। রুটগুলো সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে অপরিচিত নয়। ‘ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রকারন্তরে ইয়াবার সংকোচন নয়, এর সম্প্রসারণেরই আভাস দেয়। মাদকবিরোধী বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৪৮৬ জনের মধ্যে কক্সবাজারে নিহত হয়েছেন ৪ নারীসহ ২০৭ জন। আত্মসমর্পণ করেন শতাধিক মাকদ ব্যবসায়ী। কিন্তু তাতেও ইয়াবা দুর্লভ হয় না।
মাদকের এমন ছড়াছড়ি সত্ত্বেও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিগতভাবে দুর্বলই থাকছে। ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সারা দেশে লোকবল ছিল দেড় হাজারের কম। তিন দশকে বেড়েও তা সাড়ে তিন হাজার ছাড়ায়নি। ১৯৯০ সালের পর ২০১৮ সালে বড় রকমের আইন সংস্কার হলো। হেরোইনের ক্ষেত্রের মৃত্যুদণ্ড ইয়াবাতেও প্রযোজ্য হলো। কিন্তু তার সুফল মিলল না। বরং নতুন আইনের পরে ১৬ মাসের বেশি সময় ধরে অন্তত এক লাখ মাদক মামলার বিচার বন্ধ। কারণ, ট্রাইব্যুনালটাই গঠিত হলো না। সরকারি নির্লিপ্ততায় হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হলো। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় আইন সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদিত হলো। কিন্তু এটি কবে নাগাদ আইনে পরিণত হবে এবং কবে আদালতগুলো কার্যকর হবে, তা অনিশ্চিত। আবার, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ১৫ শতাংশের কম। সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত যা করে দেখিয়েছেন, তাতে বেশি লোকের ‘দ্রুত বিচার’ কী ফল বয়ে আনবে, তা–ও এক প্রশ্ন। কারণ, আইএনসিবির রিপোর্ট বলেছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৬ হাজার ৫৯১ জন শাস্তি পান, ছাড়া পান মাত্র একজন।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে প্রচলিত কৌশলগুলো তেমন কাজে দিচ্ছে না। অবশ্যই জনপ্রশাসনের অদক্ষতা ও দুর্নীতি বিরাট বাধা। তবে প্রচলিত ব্যবস্থাপনার খোলনলচে বদলানোর কথাও ভাবতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত লোকবল ও লজিস্টিকস দিয়ে
তাকে শক্তিশালী করতে হবে, দুর্নীতি দূর করতে হবে, দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।। তবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ঘাটতি ঘোচাতে হবে সর্বাগ্রে।