সাম্প্রতিক কালে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে চরম বোধ-বুদ্ধিহীনতা, অসহিষ্ণুতা ও নিষ্ঠুরতাই প্রকাশ পাচ্ছে। তবে এর পেছনে যে কেবল সামাজিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কাজ করেছে, তা ভাবার কারণ নেই। আছে হীন রাজনৈতিক স্বার্থও।
নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছনার বিষয়টি আমাদের ব্যথিত ও বিচলিত করে। তাঁর কলেজের এক শিক্ষার্থী ভারতের বিজেপির বহিষ্কৃত এক নেত্রীকে নিয়ে একটি পোস্ট দেয়, যার জেরে কলেজের সামনে বিক্ষোভ হয়। এই পোস্টের সঙ্গে স্বপন কুমার বিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তাঁকেই জুতার মালা পরে কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তা–ও জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে। জেলা প্রশাসক বলেছেন, ঘটনাটি তাঁর অগোচরে ঘটেছে। আর পুলিশ সুপারের ভাষ্য, পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত ছিল। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তার এই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। এ ঘটনায় নড়াইলের প্রশাসন ও পুলিশ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবে আর জেলা প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকা কর্মকর্তারা তা মেনে নেবেন, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং তঁাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।
স্বপন কুমার বিশ্বাসের লাঞ্ছনার ঘটনার মতো উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই গত শনিবার ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমারকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। রোমহর্ষক এই ঘটনা ঘটিয়েছে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির এক ছাত্র। এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার দায়ে শিক্ষক ওই ছাত্রকে শাসিয়েছিলেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে এক শিক্ষিকাকে কুপিয়ে আহত করেছেন এক রোহিঙ্গা তরুণ। এসব ঘটনার যাঁরা শিকার হয়েছেন, তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় এ ধারণাই দেয় যে এর পেছনে সামাজিক সমস্যার বাইরে অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে।
নিকট অতীতে আরও অনেক শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কথিত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের ‘শান্ত’ করতে।
তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ক্লাসে ফিরে যেতে পারলেও নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত তাঁর অপমানের প্রতিকার পাননি। কয়েক বছর আগে একজন সংসদ সদস্য তাঁকে কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য করেছিলেন।
শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের লাঞ্ছনা ও উৎপল কুমার হত্যার ঘটনা সমাজে কিছুটা হলেও নাড়া দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। ১৭ বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দুই ক্ষেত্রেই এসব ঘটনার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিতে না পারার বিষয়টি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সংবেদনশীলতা বা রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব ঘটনা উপেক্ষা বা এড়িয়ে যাওয়ার যে নীতি দৃশ্যমান, তা খুবই বিপজ্জনক। আমরা আশা করব, সঠিক তদন্ত এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। তা না করা গেলে আমাদের সামনে আরও অবক্ষয় ও অধঃপতনের দিন অপেক্ষা করছে।