জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২২’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে জনসংখ্যার যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে ইতিবাচক দিকই বেশি। নারীদের গড় আয়ু ৭৫ বছরে উন্নীত হওয়া ও দম্পতিদের গড়ে দুটি সন্তানের জন্ম দেওয়া সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছর। পুরুষের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর এবং নারীর ৭৪ দশমিক ৫ বছর। বর্তমানে জনসংখ্যার ৬ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি।
স্বাধীনতার পর থেকেই জনসংখ্যাকে অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে ধরে নিয়ে পূর্বাপর সরকার এর নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে। ধারাবাহিক কার্যক্রমের ফলে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর) ২ দশমিক ৩-এ নিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে; যা সত্তরের দশকে ছিল ৬ দশমিক ৩। ইউএনএফপিএ টিএফআর এখন ১ দশমিক ৯ দাবি করলেও বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেছেন, ‘ইউএনএফপিএ অনুমিত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে। এটা প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত নয়। মহামারির কারণে অনেক সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাল্যবিবাহ বেড়েছে, কিশোরী গর্ভধারণও বেড়েছে। তাই বাংলাদেশ প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হারে পৌঁছে গেছে, এটা বলার সময় এখনো আসেনি।’
আমরাও মনে করি, ইউএনএফপিএর ইতিবাচক প্রতিবেদন দেখে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যা-ই হোক, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারিনি। এখনো অনেক নারীকে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ধারণ করতে হয় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী হাতের নাগালে না থাকার কারণে। ইউএনএফপিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৩ শতাংশ দম্পতি কোনো না কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যদিও বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল ৭২ শতাংশ। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমবে। এ ছাড়া দেশে বাল্যবিবাহের হারও খুব একটা কমেনি। করোনাকালে বাল্যবিবাহের হার হঠাৎ করে বেড়ে যায়। দেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি।
ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো দেশে ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৭৩ জন মায়ের মৃত্যু হয়। মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে হলে প্রসবের সময় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে এখনো বহু সন্তানের জন্ম হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালের বাইরে। সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গেছে বলে দাবি করে। কিন্তু শতভাগ প্রসূতিসেবা নিশ্চিত না করলে মাতৃমৃত্যুহার কমবে না।
এ অবস্থায় জনসংখ্যার বিষয়টি দেখতে হবে সামগ্রিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে। প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ না করে জনসংখ্যাকে জনসম্পদ দাবি করা কেবল অবাস্তব নয়, হাস্যকরও। দেশে আর একটিও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও বাল্যবিবাহ যেন না হয়, সেই লক্ষ্যে সরকারকে টেকসই ও কার্যকর কর্মসূচি নিতে হবে।