কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে গত সোমবার যা ঘটে গেল, তা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘শুধু দস্তুরমতো একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমতো এক সংঘটন।’
ওই দিন বিকেলে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশের মেয়েরা নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে কার্যত বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আস্ত একটি ইতিহাস গড়েছেন। সেই ইতিহাস অভূতপূর্ব আনন্দ আর অবিস্মরণীয় সাফল্যের ইতিহাস।
এই নারী ফুটবল দলের দক্ষিণ এশিয়া জয়ে বিস্ময় যতই থাক, সেটি যে কোনো দৈবক্রমিক আকস্মিক সাফল্য নয়; এই সাফল্য যে ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ধর্মী স্পৃহাসঞ্জাত অদম্য একঝাঁক নারীর ইস্পাতকঠিন প্রত্যয় ও ধারাবাহিক সংগ্রামের অনিবার্য ফসল, তা বিগত খেলাগুলোর ফলের মধ্যে প্রতীয়মান হয়েছে।
কারণ, সেমিফাইনালে তাঁরা ভুটানকে হারিয়েছেন ৮-০ গোলে। তার আগে, অর্থাৎ সেমিফাইনালে উত্তরণের পথে তাঁরা ভারতকে ৩-০, পাকিস্তানকে ৬-০ এবং মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারিয়েছেন। অর্থাৎ এক অপ্রতিরোধ্য ধারায় তঁারা এই জয়ের পথের প্রতিটি ধাপ অবলীলাক্রমে অতিক্রম করেছেন।
এটি আর অবিদিত নয়, আজকের এই নারী ফুটবল দলের সাবিনা-সানজিদা-কৃষ্ণা-মারিয়াদের হিমাদ্রি শিখরে আরোহণের পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তাঁদের অনেকেই অতি দারিদ্র্যক্লিষ্ট প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১৫ সালে প্রথম আলোয় ‘ফুটবল রাঙাচ্ছে কলসিন্দুরের মেয়েরা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের যে লড়াকু মেয়েদের কথা ছাপা হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই এই জয়ের অগ্রগামী সেনা।
এই নারী ফুটবলারদের দুর্বার জয়যাত্রার পেছনে আছে অনেক দিনের সাধনা, পরিকল্পনা, হাড়ভাঙা পরিশ্রম। এ পেছনে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) দূরদর্শিতা ভূমিকা রেখেছে। মেয়েদের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট থেকে জাতীয় দলে খেলতে নিয়ে আসার জন্য তারা কাজ করছে অনেক আগে থেকে। গোলাম রব্বানী ২০০৮ সাল থেকে এঁদের কোচ।
২০১২ সাল থেকে কিশোরী ফুটবলারদের ঢাকায় ফুটবল ফেডারেশন ভবনে রেখে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। তখন কোনো স্পনসর ছিল না। তখন এই মেয়েদের হোস্টেলে থাকতে হয়েছে। তাঁদের খাবার, পোশাক, প্রশিক্ষণের খরচ তাদের পক্ষে জোগানো দুঃসাধ্য ছিল।
অবশেষে ফুটবল ফেডারেশন ভবনেই আবাস হয় তাঁদের। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে এই টিম একসঙ্গে থাকছে, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, খেলছে। বছরের পর বছর ধরে মা-বাবা ও গ্রাম ছেড়ে এসে একাগ্র সাধনা করছেন। নিচ্ছেন পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ। করছেন কঠোর পরিশ্রম।
একসঙ্গে থেকে হেসেখেলে একটা অভিন্ন আত্মার দল হয়ে উঠেছেন। প্রচুর প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। সেই সাধনা থেকেই সিদ্ধি এসেছে। দক্ষিণ এশিয়া তাঁরা জয় করেছেন। সামনের লক্ষ্য এশিয়া। দৃষ্টি থাকবে আরও দূরে। এই আশা অহেতুক নয়, তাঁদের এই সংগ্রাম বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের অন্যান্য শাখার খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করবে।
সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের এই ট্রফি জয়ের মধ্যে নারী অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের চেতনার দ্যোতনাও নিহিত আছে। তঁাদের পায়ে ভর করে অগণিত নারী আত্মপ্রত্যয়ে জেগে ওঠার বল পাবেন।
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?’—বিধাতার প্রতি রবি ঠাকুরের এই অনুযোগসিক্ত খেদোক্তি যে বিফলে যায়নি, তা নিষ্ঠুর সামাজিক প্রতিবেশ থেকে উঠে আসা মেয়েরা বিশাল অতিক্রমণের ইতিহাস তৈরি করে, নারীশক্তির আলাদা অভিজ্ঞান দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন। তাঁদের অভিনন্দন। তাঁদের অভিবাদন।