আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার অনেকটাই বোরো ধান উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল, আবার বোরোর মোট উৎপাদনের বড় একটা অংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। গত কয়েক বছর আবহাওয়ার একটি সাধারণ প্রবণতা হলো এপ্রিল-মে মাসে ভারতের মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি হওয়ার কারণে হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে দুর্বল বাঁধ ভেঙে হাওরে ফসলহানি প্রতিবছরই ঘটে চলে। এ বছরও নির্ধারিত সময়ে সব বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, সময়মতো বাঁধ তৈরি না হওয়ার কারণে কেন প্রতিবছর একই ঘটনা ঘটতেই থাকে?
২০১৭ সালে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরে ব্যাপক ফসলহানি হয়। সে সময় বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন স্থানীয় কৃষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সমালোচনার মুখে ঠিকাদারি প্রথা বিলুপ্ত করে অংশীজন, প্রশাসন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যুক্ত করে প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নীতিমালা অনুযায়ী পিআইসিতে মূল অংশীজন হলেন প্রকৃত কৃষক।
কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই প্রকৃত সুবিধাভোগী কৃষকদের সামনে রেখে পিআইসিগুলো মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে আবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দারুণ ঐকমত্য রয়েছে। ফলে প্রকল্পের সংখ্যা ও প্রকল্পের বাজেট বাড়ানোর দিকেই মূল মনোযোগটা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। অনিয়ম ও গাফিলতির কারণে সময়মতো বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় সেই আগের ঝুঁকি থেকেই গেছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, সুনামগঞ্জে এবারও হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ সময়মতো শেষ হয়নি। প্রকল্পে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই সব কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১০ দিন সময় বাড়ানোর পরও দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশের বেশি কাজ হয়নি। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দাবি, হাওরের বাঁধ নির্মাণের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সব কাজ নীতিমালা অনুযায়ীই চলছে।
কিন্তু পাউবোর এ ভাষ্য হাওরের কৃষকদের মতো আমাদের আশ্বস্ত করতে পারছে না। নীতিমালা অনুযায়ী নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন করে ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে কাজ শুরুর কথা থাকলেও সেটা করা হয়নি। এর চেয়ে নীতিমালার খেলাপ আর কী হতে পারে? সময়মতো বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তড়িঘড়ি করে কাজ করা হয়েছে। ফলে অনেক বাঁধই কাঁচা থেকে যাবে। আগাম বন্যা প্রতিরোধের মতো সক্ষমতা সেগুলোর থাকবে না।
দেখা যায় যে হাওরে যথাসময়ে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে প্রতিবছরই প্রশ্ন ওঠে। গত বছরেও আকস্মিক বন্যায় হাওরে ব্যাপক ফসলহানি হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না। আগাম বন্যার মতো সংকট তৈরি হলে সরকারের তরফ থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। আবার সংকট কেটে গেলেই সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্যের প্রাপ্যতা নিয়ে যখন বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তখন হাওরে যথাসময়ে বাঁধ নির্মিত না হওয়া উদ্বেগজনক ঘটনা। এবারও যদি দুর্বল বাঁধ ভেঙে ফসলহানি হয়, তাহলে সেই ক্ষতি কে পূরণ করবে? সবার আগে পিআইসিকে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু জরুরি সেই কাজ করবে কে?