শুভসূচনা, দৃশ্যমান আরও পদক্ষেপ দরকার

সম্পাদকীয়

অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস হলো আজ ৮ সেপ্টেম্বর। এক রক্তক্ষয়ী ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের ফসল এই সরকার। বলা যায়, পাহাড়সম দায়িত্ব নিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সেই দায়িত্বের অনুপাতে কতটুকু করা গেছে, তা যাচাই করে দেখার জন্য এক মাস মোটেই যথেষ্ট সময় নয়। তবে গত এক মাসে এই সরকার যা করেছে, তা সম্ভাবনাময় এক শুভসূচনা।

গত প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসন রাষ্ট্রের প্রায় সব কাঠামোকেই ধ্বংস করে ফেলেছে। এ সময়কালে আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় চলা লুণ্ঠনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই স্বৈরশাসনের অবসানের পর মানুষের মধ্যে জেগে উঠেছে রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার বিপুল আশা ও উদ্দীপনা।

দেশের মানুষের এই বিপুল প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সত্যিই এক বড় চ্যালেঞ্জ। মাত্র এক মাস সময়ে এর কোনো মূল্যায়ন করাও অসম্ভব। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, গত এক মাসে সরকার কিছু উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা পরিষ্কার হয়েছে যে আর্থিক খাত নিয়ে সরকারের বিশেষ মনোযোগ আছে। বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে ব্যাংকগুলোকে মুক্ত করে নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পুঁজিবাজারের অনিয়ম–দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করতে এরই মধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কালাকানুন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষরও সম্পন্ন করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে এমন কোনো প্রয়াস রুখতে কাজে লাগবে।

তবে অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। দলীয়করণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন যে বিশৃঙ্খলা চলছে, সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটিও সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। বলা যায়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এক গোলকধাঁধার মধ্যে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশ ও সমাজ নিয়ে ইতিবাচকভাবে অংশগ্রহণের জোয়ার বইছে। এই উদ্দীপনাকে ধারণ করার মতো শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

আইনশৃঙ্খলা ক্ষেত্রে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। শিল্পাঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা ও বিভিন্ন স্থানে নতুন চাঁদাবাজ গোষ্ঠীর আবির্ভাবের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশকে এখনো পুরোপুরি সক্রিয় করা যায়নি। রদবদল শুরু হলেও প্রশাসনে পুরো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেছে, এমন বলা যাবে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

শত শত প্রাণ দিয়ে জনগণ পরিবর্তন এনেছে। তাই জনগণের আকাঙ্ক্ষাও বিপুল। জাতি-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ দেশের মানুষ মর্যাদাপূর্ণ জীবন দাবি করতে পারে। ছাত্র-জনতার উৎসর্গের প্রাপ্য তাই ফিরিয়ে দিতে হবে। এই কাজের সূত্রপাতও এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। সে জন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন। তবে প্রস্তুতি রাখতে হবে যেন কম সময়ের মধ্যে অনেক কিছু করা যায়।

জনগণ দৃশ্যমান পরিবর্তন চায়। আমরা মনে করি, জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য সরকারকে কিছু দৃঢ় ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবর্তন দৃশ্যমান হলেই তারা এই ভরসা পাবে যে সত্যিই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে।