২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার আগে থেকে চালু থাকা প্রাথমিকের সঙ্গে মাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জানুয়ারি উৎসব আয়োজন করে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বই দেওয়া হয়। ফলে খ্রিষ্টীয় বছরের প্রথম দিনটি বই উৎসব দিবস হিসেবেও পালিত হয়ে আসছে।
শিক্ষাব্যবস্থায় নানা গলদ থাকা সত্ত্বেও সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসিত। শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই পৌঁছানো ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। এটি নিশ্চয়ই আশার কথা। কিন্তু যে খবর আমাদের আশাহত করে, সেটি হলো শিক্ষার্থীদের হাতে ভুলে ভরা ও নিম্নমানের বই বিতরণ। পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে সব বছরই কমবেশি জটিলতা দেখা দেয়।
এবারের পরিস্থিতি ছিল আরও সংকটজনক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, সে কথা সবার জানা। কিন্তু ঠিকাদার নির্ধারণে বছরের প্রায় পুরো সময় পার করার কী যুক্তি থাকতে পারে? প্রতিবছর ছাপার কার্যাদেশ দিতে অযথা বিলম্ব করা হয় এবং শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে বই ছাপা হওয়ায় মান খারাপ হয়।
প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে যেসব ভুলের চিত্র উঠে এসেছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এসব ভুলের অনেকগুলো পুরোনো পাঠ্যক্রমের। অর্থাৎ আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের ভুল শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ শীর্ষক বইয়ের যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, তাতে পাঠ্যবইয়ের রচয়িতারা সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের কথা বলতে গিয়ে কেবল তথ্যগত ভুল করেননি, বিষয়টিকে অহেতুক জটিল করেছেন।
প্রকৃত ঘটনা হলো ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নতুন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করান। বইয়ে লেখা হয়েছে, বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েম শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন।
একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যাবিষয়ক অংশে প্রথম লাইনে বলা হয়েছে, ‘২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল।’ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতেই নিরীহ বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।
যেখানে সরকার ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালন করে থাকে, সেখানে ২৬ মার্চ গণহত্যা শুরু করার কথা বলাকে অমার্জনীয় ভুল হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। কেবল ইতিহাসের বইয়েই নয়, আরও অনেক পাঠ্যবইয়ে এ ধরনের ভুল ও অসত্য তথ্য আছে, যা অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা বলার চেষ্টা করেছেন, সময়ের অভাবে এবার তাঁরা মুদ্রিত বইয়ের মান যাচাই করার, পরীক্ষা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু বইয়ের ছাপার মান অতীতে ভালো ছিল, এ কথাও কেউ বলবেন না।
এর কারণ, কার্যাদেশ দেওয়ার আগে ঠিকাদারদের সঙ্গে তাঁরা দর-কষাকষি করলেও পরে তদারকি করেন না। তদারকি করলে পৃষ্ঠা-ফর্মার ওলট-পালট কিংবা কালি কমবেশি হওয়ার কথা নয়।
অবিলম্বে ভুলে ভরা বই সংশোধন ও নিম্নমানের ছাপা বই ফেরত এনে শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্পন্ন বই পৌঁছানো হোক।