বাংলাদেশে বেকার আছে কি নেই, সেটা আর বিতর্কের বিষয় নয়। বিসিএসসহ যেকোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরির বিপরীতে আবেদনপত্রের সংখ্যা দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অনেক সময় একটি পদের বিপরীতে কয়েক শ প্রার্থী আবেদন করে থাকেন।
এই বাস্তবতায় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি যে তথ্য তুলে ধরে, সেটা কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গত বছরের শেষ তিন মাসে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে ৪০ হাজার। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ।
এর মধ্যে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী বেকারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার। এক বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা ৪০ হাজার বেড়ে গেছে।
বিবিএসের এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে অর্থনীতিবিদেরা একমত নন। তাঁদের মতে, দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, বেকারের সংখ্যা, বিনিয়োগসহ সরকারি যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে, সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সব সময় প্রশ্ন রয়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা ডলার-সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও নতুন বিনিয়োগ না হওয়াকে বেকারত্ব বাড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুই বছর ধরে দেশ করোনা সংকটের মধ্যে ছিল, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগও কমেছে। ডলার-সংকটের কারণে অর্থনীতির যে মূল চালিকা শক্তি গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহেও মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বেকারত্ব বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
বিবিএস বলছে, সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেননি, কিন্তু কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাঁদেরই বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি জরিপের আগে ৩০ দিন বেতন বা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন, তাঁরাও বেকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। যেখানে রাত-দিন পরিশ্রম করেও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ সংসার চালাতে পারছেন না, সেখানে সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা কাজ পাওয়া তাঁদের জন্য কোনো অর্থ বহন করে না। এটা কোনোভাবে বেকারত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে না। দেশে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান নেই বলেই বেকার তরুণেরা জীবনবাজি রেখে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাঁদের ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিটা দেশের বাইরে প্রবাসে যান। তাই দুই দশক ধরে বেকারের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৮ লাখের মধ্যে আছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো কর্মপরিকল্পনা আমরা দেখছি না। অতএব সরকার যদি বেকারত্ব কমাতে চায়, প্রথমে কিন্তু ব্যাংকিং খাত কি তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে? অনেক ব্যাংকই এখন তারল্যসংকটে ভুগছে।
অর্থনীতির প্রতিটি শাখা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে বা পেছনে ফেলে অন্যগুলোকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। বেকারত্বের বিষয়টি দেখতে হবে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে। বেকারের হার কমাতে হলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে, যেখানে বেকার তরুণেরা কাজের সন্ধান পাবেন।