প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর বলছে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত দুই মাসের মতো সময় রাখতে চায়। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। নির্বাচন কমিশন আগে থেকেই বলে আসছিল, আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে এবং নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করা হবে।
জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। চলতি সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। এর আগের ৯০ দিন; অর্থাৎ আগামী ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সাধারণত নির্বাচনের ৪০ থেকে ৪৫ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। মাঝখানে ৪৫ দিন সময় রেখে ভোটের তারিখ ছিল ২৩ ডিসেম্বর। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ভোটের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছিল।
দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। ভোট গ্রহণ করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। তফসিল ঘোষণা ও ভোট গ্রহণের মধ্যে সময় ছিল ৪০ দিন। ওই নির্বাচনে যেহেতু নিবন্ধিত অধিকাংশ দল অংশ নেয়নি, সেহেতু তাদের দাবি মেনে ভোটের তারিখ পেছানোর প্রশ্ন ছিল না।
এবার কী এমন ঘটনা ঘটল যে নির্বাচন কমিশনকে দুই মাস আগে থাকতে তফসিল ঘোষণা করতে হবে? যুক্তি দেখানো হয়েছে, প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হলে আপিল নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া। নির্বাচন কমিশন এমন সময়ে বেশি সময় নিয়ে তফসিল ঘোষণার কথা বলছে, যখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তফসিলের আগেই এক দফার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চায়। আগেভাগে তফসিল ঘোষণা হলে জনমনে এ ধারণাই হবে যে সরকারের ইচ্ছায় ইসি এ কাজ করছে। এর আগে তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে।
এবার কী উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন লম্বা সময় রেখে তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে, সেই ব্যাখ্যাও তাদের দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি ২০১৪ সালের মতো একতরফা একটি নির্বাচন করতে চায়, তাহলে তারা যেকোনো সময়ে তফসিল ঘোষণা করে নিয়ম রক্ষার ভোট করতে পারে। কিন্তু ইসি যদি একটি সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আশা করে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে অংশ নিতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে লম্বা সময় নিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হলে মাঠপর্যায়ে পুলিশ ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রার্থীদের আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করা ইসির জন্য কঠিন হবে।
নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনটি হলো জনগণের প্রতিনিধি বাছাইয়ের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। এখানে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয় বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
অতীতে একাধিক নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পরও মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, চূড়ান্ত তালিকা ও ভোট গ্রহণের তারিখ বদল করা হয়েছে। ৪০ থেকে ৪৫ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করার পরও বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভোটের তারিখ বদলের সুযোগ থাকবে।
এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে জনমনে এ ধারণা হয় তারা সরকারের অভিলাষই পূরণ করতে যাচ্ছে। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের হলেও মাঠ সমতল রাখার দায়িত্ব পুরোপুরি ইসিরই। অতএব ভেবেচিন্তেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।