জালিয়াত চক্রকে খুঁজে বের করুন

সম্পাদকীয়

যেখানে দেশের প্রকৃত নাগরিকেরা সিটি করপোরেশন থেকে জন্মসনদ ও মৃত্যুসনদ নিতে নানা হয়রানির শিকার হন, সেখানে রোহিঙ্গারা কী করে অনায়াসে এনআইডি পেয়ে যান? এর পেছনে যে সংঘবদ্ধ কোনো চক্র জড়িত, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

যেকোনো ব্যক্তি এনআইডি চাইলেই পাওয়ার কথা নয়। আবেদনকারী ব্যক্তি প্রকৃতই বাংলাদেশের নাগরিক কি না, সেটা যাচাই করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার সংস্থা তথা সিটি করপোরেশনের। তারা যদি কাজটি সততার সঙ্গে করত, তাহলে রোহিঙ্গারা এনআইডি পেতেন না। এনআইডি দেখিয়ে তাঁরা পাসপোর্টও হাতিয়ে নিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে ধরাও পড়ছেন; কিন্তু জালিয়াতি বন্ধ হচ্ছে না।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪৯ জনকে জন্মনিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। ৫ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন শাখার রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দেওয়া একটি চিঠিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটির কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে জানানো হয়, ওই ৪৯ জন রোহিঙ্গার জন্মসনদ দেওয়ার সময় যেসব নিবন্ধক ও নিবন্ধন সহকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাঁদের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে দেওয়া জন্মনিবন্ধন নম্বরগুলো যাচাই করে দেখা হয়েছে। সার্ভারে ওই জন্মনিবন্ধন নম্বরগুলোর অস্তিত্ব নেই। ওই জন্মসনদগুলো অবৈধ বলেও জানান তিনি।

গত ২৬ মে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে দেওয়া চিঠিতে ১০২ জন অবৈধ উপায়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জন্মনিবন্ধন নিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়েছেন বলে জানানো হয়। অনুসন্ধানে ওই ব্যক্তিদের পাসপোর্টে উল্লিখিত স্থায়ী ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায়নি। রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ দেওয়ার অভিযোগ কেবল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে নয়। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত। নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন দপ্তর থেকেও তাঁদের এনআইডি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটেনি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দাবি, তাদের সার্ভারে অভিযুক্ত কারও নামে জন্মসনদ নেওয়া হয়নি। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জন্মনিবন্ধনে জালিয়াতি করায় এক কর্মীকে চাকরিচ্যুত ও এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাঁদের কেন পুনর্বহাল করা হলো? তাঁরা কি নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পেরেছেন?

আসলে নাগরিকদের সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একশ্রেণির কর্মকর্তা–কর্মচারী সুযোগ পেলেই নানা জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই বড় হয়ে যায়। একটি ভুয়া জন্মসনদ দিয়ে তাঁরা যে দেশ ও জাতির কত বড় ক্ষতি করছেন, সেটা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এর আগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুই ভাই ভুয়া পরিচয়ে এনআইডি করিয়ে নিয়েছিলেন। যেসব স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হোক।

ভুয়া জন্মসনদ দেখিয়ে যাতে কোনো বিদেশি নাগরিক এনআইডি বা পাসপোর্ট নিতে না পারেন, সে জন্য নির্বাচন কমিশন ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। যাঁরা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। দু–চারজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলেই অন্যরা এই জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করতে সাহস পাবেন না।