ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রতিকৃতি পোড়ানো এবং সহিংস বিক্ষোভের ঘটনায় আমরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে একধরনের টানাপোড়েন চলে আসছে। এ অবস্থায় পতাকা অবমাননার মতো প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করেই উত্তেজনা ও বিভক্তি বাড়াচ্ছে।
যেকোনো দেশের মিশন ও এর কর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব স্বাগতিক দেশের। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করলাম, বৃহস্পতিবার বিকেলে বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ নামের একটি সংগঠনের কর্মসূচির সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে এবং কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের সব মিশন এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই সহিংস বিক্ষোভকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো অবকাশ নেই। কেননা, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতের রাজনৈতিক মহলের কেউ কেউ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে ধরনের উত্তেজক বক্তব্য দিচ্ছেন, তা বস্তুনিষ্ঠ তো নয়ই, বরং বিভেদ উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মাঠের রাজনীতি ছাড়িয়ে ভারতের লোকসভায় গিয়েও এটি পৌঁছেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর লোকসভায় বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতির ওপর ভারত গভীরভাবে নজর রাখছে। ফলে এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে বাংলাদেশবিরোধী কথাবার্তাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ভারতের অনেক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে এমন খবর পরিবেশন করা হচ্ছে, যেটা ভিত্তিহীন ও অতিরঞ্জিত। কিছু কিছু সংবাদপত্রে খবর পরিবেশনার ধরন এমন যে তারা যেন বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও সয়লাব হয়ে যাচ্ছে অপতথ্য ও গুজবে। সর্বশেষ আমরা এর দৃষ্টান্ত দেখলাম সাবেক ইসকন সদস্য ও সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায়। চট্টগ্রাম আদালতে তাঁর অনুসারীরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত বেধে যায়। একপর্যায়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে মিথ্যা দাবি করা হয় যে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে।
আমরা মনে করি, এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রভাব বহুমুখী। এতে দুই দেশের বহুমাত্রিক ও বহুমুখী সম্পর্কে যেমন স্থায়ী তিক্ততার সৃষ্টি হতে পারে, আবার সামাজিক অস্থিরতাও তৈরি হতে পারে। কূটনীতিক ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর মনে করেন, ৫ আগস্টের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণ হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা তারা মানতে পারেনি।
ফলে দুই দেশের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য ৫ আগস্টের আগের বাংলাদেশ আর ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশ যে এক নয়, ভারতের নীতিনির্ধারকদের সবার আগে এই বাস্তবতা মানতে হবে। ভারতেই যেখানে সংখ্যালঘুরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে কথা বলা কূটনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থী।
নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কটা শুধু ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, কৌশলগত দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। পরিবর্তিত বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার আলোকেই দুই দেশের মধ্যে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, কূটনৈতিকভাবেই তার সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য ও সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।