আর কত দুর্ঘটনা, আর কত প্রাণহানি

সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এত আইন হলো, এত পরিকল্পনা নেওয়া হলো, কিন্তু কোনো কিছুই কাজে লাগছে না। এটা যেমন আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা, তেমনি সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলাও বটে।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে মারা গিয়েছিল দুই কলেজশিক্ষার্থী। সেই ঘটনা দেশবাসীকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার সড়ক পরিবহন আইন করতে বাধ্য হয়েছিল।

আমাদের প্রত্যাশা ছিল এই আইন পাসের পর সড়কে দুর্ঘটনা কমবে, যাত্রী ও পথচারীরা নিরাপদ থাকবেন। কিন্তু বিগত সরকার নানা মহলের চাপে সেই আইনটিকে কাটছাঁট করে একটি অকেজো আইনে পরিণত করে। ফলে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি আরও বেড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা নিরাপদ করতে দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ এখনো অনুপস্থিত।

রাজধানীর বাড্ডায় দুই বাসচালকের মধ্যে প্রতিযোগিতায় সড়কে আবারও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বুধবার সকাল সোয়া নয়টার দিকে যখন দুই বোন মধ্যবাড্ডায় প্রগতি সরণি পার হচ্ছিলেন, তখনই আকাশ পরিবহনের দুটি বাস একটির সঙ্গে আরেকটি পাল্লা দিচ্ছিল। একটি বাসের ধাক্বায় ছোট বোন তাসনিম জাহান নিহত হন এবং বড় বোন নুসরাত জাহান আহত হন। তাসনিম সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বাড্ডা এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন। বাস দুটি জব্দ ও চালককে আটক করা হয়েছে।

এদিকে বুধবার রাতে পিরোজপুর সদর উপজেলায় একটি প্রাইভেট কার খালে পড়ে দুই পরিবারের মোট আট সদস্য নিহত হন, যাদের দুজন পুরুষ, দুজন নারী ও চারটি শিশু রয়েছে। নিহতদের স্বজন জানান, প্রাইভেট কারটির পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে পিরোজপুরের নাজিরপুর হয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল।

এসব ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা বরারই ভঙ্গুর ছিল। সাম্প্রতিক কালে ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও সড়ক মেরামত না হওয়ায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে, কখনো চালকের বেপরোয়া চালনায়, কখনো সড়কে খানাখন্দ থাকায়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে ৩৯২টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে, মারা গেছেন ৪২৬ জন। এর মধ্যে ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, যা মোট দুর্ঘটনায় ৪১.৮৩ শতাংশ। আর নিহতদের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৯ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪২ শতাংশ। এর অর্থ মোটরসাইকেলচালকেরা কোনো নিয়মরীতিই মানছেন না।

সম্প্রতি দেশের কয়েকটি অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হওয়ায় অনেক সড়কে খানাখন্দ বেড়েছে। কোনো কোনো সড়কে যান চলাচল করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। খোদ ঢাকা শহরের বেশির ভাগ সড়ক বেহাল। এ অবস্থায় দ্রুত সড়ক মেরামত করার প্রয়োজন থাকলেও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইন জারি হওয়ার পর চালকদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয় ছিল, দুর্ঘটনা হলে শাস্তি পেতে হবে। পরবর্তী সময়ে আইনটি সংশোধনের নামে এমন অবস্থায় আনা হয়েছে যে তাদের মধ্যে সেই ভয়ভীতি আর নেই।

পিরোজপুরের দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন চালক কী অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গাড়ি চালানোর আগে তিনি প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিয়েছিলেন কি না। আর ঢাকার দুর্ঘটনায় যে দুই চালক প্রতিযোগিতা করে একজন নারীকে হত্যা এবং আরেকজনকে আহত করেছেন, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে।

সড়ক পরিবহন আইনটি নতুন করে সংস্কার করে কার্যকর করা হোক।