অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনুন

সম্পাদকীয়

একজন সদ্য সাবেক সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে তাঁরই সহযোগীরা সংরক্ষিত বনের জায়গা দখল করে অবৈধভাবে যে বাঁধ তৈরি করেছিলেন, প্রথম আলোয় খবর প্রকাশের পর সেটি বন বিভাগ কেটে দিয়েছে। কিন্তু বাঁধের কারণে লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার ৪ হাজার ২২৫ একর জমির চাষাবাদ যে ব্যাহত হলো, বনের কয়েক লাখ গাছ ধ্বংস করা হলো, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি যে হলো, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

২০২১ সালে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাঁধটি নির্মাণ করলেও ওই সংসদ সদস্য সাবেক না হওয়া পর্যন্ত বন বিভাগ সেটি কাটতে পারেনি। তিনি আর কেউ নন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী।

সংসদ সদস্য পদে থাকার সময় তাঁর একাধিক কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস হলেও দলের মনোনয়ন লাভে সমস্যা হয়নি। নির্বাচনে হেরে না গেলে হয়তো বন বিভাগ ও পরিবেশবাদীদের আপত্তি ও প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে বাঁধটি বহাল থাকত ও বনটি পুরোপুরি ধ্বংস হতো।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত বনটি বড়হাতিয়া নামে পরিচিত। ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে একটি বনের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমি ডুবিয়ে কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করেছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এটি তৈরি করা হয়েছিল বনের সোনাকানিয়া ছড়ায় বাঁধ দিয়ে। বন বিভাগ বলছে, হ্রদ তৈরির কারণে গামারি, সেগুন, চিকরাশি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় প্রায় পাঁচ লাখ গাছ মারা গেছে। বাঁধ দেওয়ার ফলে ছড়াটি বন্ধ হয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বাঁধ ভাঙার জন্য আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে সব ধরনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাঁধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে সফল হইনি।’ সোনাইছড়ি ছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি, তবে বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে হ্রদ পরিচালনা করতেন মো. নাছির উদ্দিন ও মনজুর আলম নামের দুই ব্যক্তি। তাঁরা সাবেক এমপির ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ কিছু করার সাহস পাননি এত দিন।’

বন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২-২৩) বলছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংরক্ষিত বনগুলোকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। দেশে এখন প্রায় ৩৩ লাখ ১১ হাজার একর সংরক্ষিত ও ১১ লাখ ৭৩ হাজার একর রক্ষিত বন রয়েছে, যার মধ্যে বড়হাতিয়া বনটিও আছে। এর আগে বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনে বন বিনষ্ট করা; বন্য প্রাণী ও পাখি শিকার; পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালীরা সেসব মামলা ও সুপারিশ আমলে নেওয়ারই প্রয়োজন মনে করেননি।

নাছির উদ্দিন দাবি করেছেন, তৎকালীন লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বাঁধ নির্মাণের জন্য তাঁদের প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু লোহাগাড়ার তৎকালীন কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম (বর্তমানে নওগাঁ সদরে কর্মরত) প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধ নির্মাণে কাউকে কোনো প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়নি। যাঁরা কথিত প্রত্যয়নপত্রের দোহাই দিয়ে সংরক্ষিত বন ধ্বংস করেছেন, কৃষিজমি বিরান করেছেন, তাঁরা জনসাধারণের স্বার্থবিরোধী গোষ্ঠী। তাঁদের নেপথ্যে যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আছেন, তাঁদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা হোক।