প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত শনিবার অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া অভিভাষণে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করার যে কথা বলেছেন, তাতে ন্যায়বিচারপ্রার্থী প্রত্যেক মানুষের আকাঙ্ক্ষাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।
অতীতে আমাদের শাসকেরা বিচারের ক্ষেত্রে আইনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। বিচার বিভাগের পদগুলোতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ না দিয়ে পছন্দসই ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারীভাবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ অনেকেই সেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের প্রায় সব সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ, স্থায়ীকরণ ও উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে কোনো আইন না থাকার মতো বিষয়গুলো রয়েছে।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদের জন্য পৃথক সচিবালয় থাকলেও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় নেই। এ থেকে বিচার বিভাগের প্রতি নির্বাহী বিভাগের বৈরী ও বিমাতাসুলভ মনোভাব পরিষ্কার। অতীতের সরকারগুলো যে বিচার বিভাগ পৃথক্করণে বিশ্বাসী, এটা তাদের কর্মকাণ্ডে কখনো প্রতিফলিত হয়নি।
প্রধান বিচারপতির মতো দেশবাসীও আশা করেন, অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নেবে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ সংস্কারের লক্ষ্যে সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেছে। কমিশন ১ অক্টোবর কাজ শুরু করবে এবং প্রতিবেদন পেশ করতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে।
আইন ও বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরও বিচার বিভাগ পৃথক না হওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ বিষয়ে কোন সরকারের কী প্রতিশ্রুতি ছিল, আর ক্ষমতায় এসে তারা কী করেছে, সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। পূর্বাপর সব সরকারই নিম্ন আদালতকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এটা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন করার কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি। আইন অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে কেউ সেই আইনের অপব্যবহার করতে না পারে, সেই রক্ষাকবচও থাকতে হবে। সদ্য পদত্যাগী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল আইন করেই। কিন্তু তারা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা না করে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করেছে।
এ অবস্থায় আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সরকারের জন্য বিচার বিভাগের সংস্কারকাজ বকেয়া রাখা ঠিক হবে না। অন্তত বিচারক নিয়োগ ও আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কাজটি অন্তর্বর্তী সরকারই করে যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ঢালাও মামলা, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি বন্ধ করার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে। কাজটি কে করবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই ঢালাও মামলার হয়রানি বন্ধ করতে হলে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।