রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু।’ মানুষের প্রাণধারণের জন্য কেবল অন্ন ও আলো হলে চলে না। মুক্ত বায়ুরও প্রয়োজন। এ কথাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা শহরের বাসিন্দারা সেটা মনে রেখেছেন কি? প্রায় দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে মুক্ত বায়ুর বড় অভাব। পৃথিবীর যেসব শহরে দূষিত বাতাস, ঢাকা তার শীর্ষে।
ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ অত্যধিক জনবসতি, খোলা মাঠের অভাব, গাছপালার স্বল্পতা। এ ছাড়া শহরের ভেতরে একের পর এক কারখানা গড়ে উঠেছে, যানবাহনের অতিরিক্ত ধোঁয়াও বাতাসকে দূষিত করছে।
ঈদের সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা থেকে বাইরে চলে যান। এ সময় কলকারখানা বন্ধ থাকে এবং যানবাহনের চলাচলও কমে যায়। ধারণা করা গিয়েছিল, এ সময় ঢাকাবাসী মানসম্পন্ন বায়ুতে নিশ্বাস নিতে পারবেন। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২ এপ্রিল কিছুটা ভালো ছিল বায়ুর মান, অর্থাৎ ৫১–এর নিচে। এবার ঈদের ছুটির পাঁচ দিনের গড় বায়ুর মান (একিউআই) ছিল ১৫১। এটি ২০২৪ সালের রেকর্ড ১৯০-এর তুলনায় ভালো। যদিও তা নিরাপদ সীমার ওপরে। ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এয়ার নাও–এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ঈদুল ফিতরের সময়ের চেয়ে এবার দূষণ কম হলেও অস্বাস্থ্যকর বায়ু থেকে সুরক্ষা পাননি নগরবাসী। এতে প্রমাণিত হয়, দূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট টেকসই ও কার্যকর কিছু করা হয়নি।
বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫১ হলে তাকে ভালো বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে বায়ুর মান মাঝারি। ১০১ থেকে ১৫০ হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকারক বলে গণ্য হয়। অস্বাস্থ্যকর ধরা হয় যদি বায়ুর মান ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে থাকে। খুব অস্বাস্থ্যকর বায়ু বলা হয়, মান যখন ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকে। আর ৩০০-এর বেশি হলে তা হয় দুর্যোগপূর্ণ। দূষণের এই মানদণ্ড পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কমবেশি মেনে চলে।
ঢাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ। দ্বিতীয় নির্মল বায়ুর জন্য যে পরিমাণ গাছপালা থাকা দরকার, তার সিকি ভাগও নেই। এসব কারণে ঢাকার বাসিন্দাদের অনেকে শ্বাসজনিত রোগে ভোগেন। চিকিৎসকেরা তাঁদের বায়ু পরিবর্তনেরও পরামর্শ দেন। কিন্তু ঢাকার বাইরে তো কর্মসংস্থান নেই। এ কারণে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে বায়ু যতটা সম্ভব নির্মল রাখার।
নগরীর দূষণ বেশি হয় নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে। এরপর এপ্রিলে দক্ষিণের বায়ু এবং এর সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া কালবৈশাখী ও বৃষ্টিতে দূষণের পরিমাণ কমে আসে। দূষণ কমানোর উপায় কী? নগরবিদ ইকবাল হাবীবের মতে, পুরো ঢাকা নগরী হলো আস্তরণহীন। নির্মাণকাজ হচ্ছে উন্মুক্তভাবে। সেখানে বালু ও ইট উন্মুক্ত থাকছে। নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা উন্মুক্ত পড়ে আছে। সেখানেও সবুজের কোনো আচ্ছাদন নেই।
অতএব বায়ূদূষণ থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সবুজ আচ্ছাদন তৈরি করতে হবে। শহরে যত বেশি গাছ লাগানো হবে, তত বেশি বায়ু নির্মল হবে। দ্বিতীয়ত, কলকারখানার ধোঁয়া বন্ধ করতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে নির্মাণকাজ করা যাবে না। সড়কে ময়লা–আবর্জনা ফেলে রাখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন থাকতে হবে।