বাংলাদেশের আরও অনেক নদীর মতো সোমেশ্বরীও একসময় খরস্রোতা ছিল। ভারতের গারো পাহাড়ে জন্ম নেওয়া এই নদী যেমন সৌন্দর্যপিয়াসী পর্যটকদের আকর্ষণ ছিল, তেমনি নদীর মৎস্য সম্পদ ছিল এলাকাবাসীর অন্যতম জীবিকা। বিশেষ করে সোমেশ্বরীর মহাশোলের খ্যাতি দেশজুড়ে।
কিন্তু অধুনা সেই সোমেশ্বরীর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে একশ্রেণির বালুখেকোর দৌরাত্ম্যে। ২১ অক্টোবর প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সোমেশ্বরী নদীর যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হবে। এতে বলা হয়, নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সোমেশ্বরী এখন আর নদী নেই, হয়ে গেছে ক্ষীণ এক জলধারা। শত শত অবৈধ ‘বাংলা ড্রেজার’ দিয়ে প্রতিদিন বালু তোলায় নদীটি এখন সংকুচিত ও ক্ষতবিক্ষত।
নদীর নাব্যতা বজায় রাখার অজুহাত দেখিয়ে ২০০৫ সালে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সোমেশ্বরী নদীতে বালু তোলার অনুমতি দেয় সরকার। ইজারা দেওয়া পাঁচটি বালুমহালের আয়তন প্রায় দুই হাজার একর। প্রতিদিন ২১ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে। দিনে বালু পরিবহন করা হচ্ছে প্রায় দুই হাজার ট্রাকে। এসব ট্রাকে অতিরিক্ত বালু পরিবহনের কারণে রাস্তাঘাটও নষ্ট হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নেত্রকোনার নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল নূর সালেহীন প্রথম আলোকে বলেছেন, অতিরিক্ত ওজন ও ভেজা বালু পরিবহনের কারণে নবনির্মিত শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কটি বহু জায়গা ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ভাঙা অংশ মেরামত করতে এখন প্রতি কিলোমিটারে এক কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।
মোদ্দা কথা, বালুখেকোরা কেবল নদীকেই ধ্বংস করছে না, তারা রাস্তাঘাট নষ্ট করে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও ব্যাহত করছে। এই বালুখেকোরা এতটাই শক্তিশালী যে স্থানীয় প্রশাসনের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে চলেছে। যাঁরা বালুমহালগুলো ইজারা পেয়েছেন, তাঁরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অননুমোদিত ড্রেজার, ভেজা বালু পরিবহন বন্ধ করাসহ জনদুর্ভোগ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর ইজারাদারদের চিঠি দেওয়া হয়। এসব চিঠি বালুখেকোদের যে নিবৃত্ত করতে পারেনি, প্রথম আলোর প্রতিবেদনই তার প্রমাণ।
এই ঘটনা যে কেবল সোমেশ্বরীতে ঘটেছে, তা-ই নয়। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী মেঘনাও ধ্বংস হতে চলেছে বালুখেকোদের দৌরাত্ম্যে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসক হয়রানির শিকার হয়েছেন, নদী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীকেও পদ হারাতে হয়েছে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে আমরাও বলতে চাই, পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে যতটা প্রয়োজন, ততটুকু বালুই উত্তোলন করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে জরিপ করে বিজ্ঞানসম্মত ড্রেজার দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বালু তোলা যেতে পারে। নির্বিচার বালু তোলা যাবে না।
তিস্তাসহ দেশের অনেক নদী মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে উজানে পানি আটকে দেওয়ার কারণে। কিন্তু সোমেশ্বরীর সমস্যাটি অন্য। এই নদীতে উজান থেকে পানি আসে ঠিকমতোই। সেই পানির সঙ্গে যে অতিরিক্ত বালু আসে, সেটি সরানোর জন্য ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হতে পারে। তাই বলে বালু তোলার নামে নদীকে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না।
অতএব, এসব বালুখেকোর হাত থেকে সোমেশ্বরীকে বাঁচাতেই হবে। নদীটির যে সর্বনাশ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, তাতে সেখানে আর বালুমহাল রাখার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। সোমেশ্বরীতে ঘোষিত সব বালুমহাল ও সব ধরনের ইজারা অতি সত্ত্বর বাতিল করা হোক। কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া বালু ব্যবসায়ী ও বালুখেকোদের থেকে এবার অন্তত সোমেশ্বরীকে রেহাই দিন।