মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে

সম্পাদকীয়

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত শনিবার পর্যন্ত ১১ দিনে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছে। দেশের ৭টি মহানগর ও ৬০টি জেলার পুলিশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি শুরু করেন ১ জুলাই। প্রথম দিকে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের হামলার পর তা ভিন্ন রূপ নেয়। পরে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা চালায়। এর ফলে সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটে।

২১ জুলাই রাত থেকে রাজধানীতে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ ও র‍্যাব। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রেপ্তার অভিযানে ‘ব্লক রেইড’ দেওয়া হচ্ছে। সহিংসতায় কারা জড়িত ছিলেন, তা বের করতে ভিডিও ফুটেজ ও ছবি বিশ্লেষণ করে তালিকাও করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থী, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও আছেন। কেউ সহিংসতা করলে সরকার তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সন্দেহজনক হিসেবে হাজার হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহার দাবি, ‘সহিংসতাকারীদের ধরতে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সহায়তায় আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। শুধু দুষ্কৃতকারীদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

এটা তো দিবালোকের মতো সত্য যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘটিত সহিংসতায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীরাও জড়িত ছিলেন। কিন্তু বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের। ভিডিও ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীদের বাদ পড়ার কথা নয়।

সহিংসতায় জড়িত ছিলেন, এমন লোকদেরই যদি গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে যাঁরা ঘটনাস্থলে ছিলেন না, তাঁদের কেন গ্রেপ্তার করা হলো? সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, যাঁরা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত নন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সংঘর্ষের সময় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এমনকি ঘটনাস্থলে না থাকা ব্যক্তিদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

এ ধরনের অভিযানে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে মামলা করে। পরে সন্দেহভাজন হিসেবে যাঁদের ধরা হয়, তাঁদের নাম আসামি হিসেবে দেখানো হয়। রোববার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, ১৭ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীকে হাতে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলা হচ্ছে। কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ককে এভাবে গ্রেপ্তার করা যায় না। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কিশোর আদালতে নেওয়া যেত। কেবল সেই কিশোরই নয়, ১৩ ও ১৪ বছরের শিশুকেও গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়ার অভিযোগ আছে।

এ ধরনের গ্রেপ্তার অভিযানে থানা-পুলিশের মধ্যে মামলার আসামি বেশি দেখানোর প্রতিযোগিতা চলে। গ্রেপ্তার অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই আইন মেনে চলতে হবে। সংবিধান নাগরিককে যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে, তা লঙ্ঘন করা যাবে না। মানুষের জানমাল রক্ষা করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তারা সেটি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। গণগ্রেপ্তার করে নিরীহ ও নির্দোষ মানুষকে হয়রানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।