বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। বিবিএসের হিসাবে, গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাই মাসে ১৪ শতাংশ ছাড়াল, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
মূল্যস্ফীতি হলে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর চাপ পড়ে। কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি গরিবদেরই মহাবিপদে ফেলে। তাঁদের আয়ের সিংহভাগই চলে যায় খাদ্যপণ্য কিনতে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতির এই উল্লম্ফন নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও প্রশ্ন জেগেছে। তাঁদের ধারণা, পূর্ববর্তী সরকারের সময় মূল্যস্ফীতির অঙ্ক ইচ্ছা করেই কমিয়ে দেখানো হতো, যাতে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়। এটা জনগণের সঙ্গে একধরনের প্রতারণাও।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন শঙ্কা ছিল মূল্যস্ফীতির তথ্য কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য হয়তো এটা করা হয়েছিল। বাজারের জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির তথ্যের মিল ছিল না।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ হওয়ার অর্থ হলো ভোক্তা যে পণ্য আগে ১০০ টাকায় কিনতে পারতেন, এখন তাঁকে সেটা কিনতে হবে ১১৪ টাকায়। সেই তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। জুলাই মাসে পণ্যের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে পণ্য সরবরাহে অচলাবস্থা। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুই সপ্তাহের বেশি দেশ অশান্ত ছিল। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতেও সমস্যা হয়েছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে যে পদক্ষেপগুলো নিতে হবে তা হলো, বিকল্প উপায়ে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো, আমদানি পণ্যের শুল্ক কমানো, যেসব পণ্যের আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, সেটি তুলে দেওয়া এবং পণ্য পরিবহনে ঘাটে–ঘাটে যে চাঁদাবাজি হতো, সেটা কঠোর হাতে রহিত করা। জ্বালানির দামও মূল্যস্ফীতির বড় একটা কারণ।
দরিদ্র মানুষ যাতে স্বল্প দামে নিত্যপণ্যগুলো পেতে পারে, সে জন্য আগের সরকার এক কোটি দরিদ্র পরিবারকে কার্ড দিয়েছে। কিন্তু এই কার্ড বিতরণে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে। প্রকৃত গরিব মানুষকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের উচিত হবে, সেগুলো যাচাই–বাছাই করে প্রকৃত অভাবী মানুষের কাছে স্বল্প দামে নিত্যপণ্য পৌঁছানো। বর্তমানে খোলাবাজারে চালসহ কিছু নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হলেও সেই কার্যক্রম কয়েকটি সিটি করপোরেশন এলাকায় সীমিত। এটা সর্বত্র চালু করতে হবে। মহলবিশেষের চাপের কারণে বিগত সরকারের আমলে ডিম ও গরুর মাংস আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। ভোক্তার অধিকারকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম হলেও সরকারের মাত্রাতিরিক্ত করের কারণে ভোক্তাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এতে সরকার লাভবান হলেও নাগরিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, জ্বালানির দাম কমানো হলে কৃষি ও শিল্প পণ্য উৎপাদন খরচও কমবে। কমবে পরিবহন ব্যয়ও।
এবারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। তাঁরা একদিকে পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের চাঁদাবাজি থেকে, অন্যদিকে বাজারের অগ্নিমূল্য থেকেও মুক্তি পেতে চেয়েছেন। এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একটু স্বস্তি দিতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতেই হবে। বিশেষ করে তাঁদের আয়ের সঙ্গে খাদ্যপণ্যের দাম সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাজারে অভিযান চালিয়ে পণ্যের দাম কমানো যাবে না। দাম কমাতে হলে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতেই হবে।