নতুন মোড়কেই ডিএসএ?

সম্পাদকীয়

পূর্বতন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরও দুটি ধারা জামিনযোগ্য করে গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আগে সরকার পূর্বতন আইনের অজামিনযোগ্য আটটি ধারাকে জামিনযোগ্য ও কিছু ধারায় শাস্তি কমানোর কথা বলেছিল।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়, তখন সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ডিজিটাল মাধ্যমের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ডিএসএ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ও ভিন্নমত দমনের কাজেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দেওয়া ভাষ্য অনুযায়ী, গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে। এ আইনে কতজনকে আটক করা হয়েছে, তা তিনি জানাতে পারেননি।

মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে ১১৫টি মামলায় ২২৯ সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৬ জনকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা করার পরপরই যাচাই-বাছাই ছাড়া আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। কেবল তা-ই নয়, একটি খবর পরিবেশনের সূত্র ধরে প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার ২০ ঘণ্টা পর তাঁর বিরুদ্ধে ডিএসএতে মামলা দেওয়া হয়। তিনি বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন। একই মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিসের (সিজিএস) বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএসএর মামলার মধ্যে ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনটি চূড়ান্ত করার আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু সরকার ১৪ দিন খসড়াটি ওয়েবসাইটে দিয়েই দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কটি অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। কিছু ধারায় শাস্তির পরিমাণ কমানো হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন না হওয়ায় সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উদ্বেগ থেকেই যাবে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের বড় দুর্বলতা হলো অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট না করা। অজামিনযোগ্য চারটি ধারা হলো ১৭, ১৯, ২৭ ও ৩৩। এর মধ্যে ১৭ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশসংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা রয়েছে।

১৯ ধারায় কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতিসাধন, ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ৩৩ ধারায় হ্যাকিং-সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো প্রস্তাবিত আইনটিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

সরকার যদি সত্যি সত্যি আইনটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ও ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না চায়, তাদের উচিত হবে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাঁদের মতামত আমলে নিয়ে আইনটি সংসদে পাস করা।

মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আইনটি চূড়ান্ত হলেও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ আছে। সংসদে আইনটি উত্থাপনের পর সংসদীয় কমিটিতে যাবে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য। সেখানেও আলোচনা হতে পারে।

সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট কথা হলো আইনটির মোড়ক পরিবর্তন করলেই হবে না, চরিত্রও বদলাতে হবে। নতুন মোড়কে পুরোনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিলে তার দায়ও সরকারকে বহন করতে হবে।