ক্রমাগত আশা হারানোটা উদ্বেগজনক

সম্পাদকীয়

আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তাতে সাধারণ মানুষ এর ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ সমীক্ষায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এটা কেবল হতাশাজনক নয়, উদ্বেগজনকও।

‘সিটিজেনস পারসেপশন সার্ভে ২০২৪ অন গভর্ন্যান্স, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি’ শীর্ষক এ সমীক্ষা হয়েছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। সমীক্ষায় দেশের ৬৪ জেলার মোট ৬ হাজার ৫১০ জন নারী ও পুরুষ অংশ নেন। প্রতি জেলা থেকে মোট ১০৬ জন করে উত্তরদাতা নির্বাচন করা হয়েছে। এর আগে ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২২ সালেও একই ধরনের সমীক্ষা করা হয়েছিল। এবারে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের নেতিবাচক মনোভাব উঠে এসেছে। অর্থাৎ তাঁরা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না।

সমীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সঠিক পথে চলছে কি না। ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, দেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক—এই তিন দিক দিয়েই ভুল পথে যাচ্ছে; যেখানে ২০১৭ সালে মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ এই ধারণা পোষণ করতেন। মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে ৪১ শতাংশ মানুষের আস্থা হারানো বিচলিত হওয়ার মতো ঘটনাই বটে।

অতীতে দেখা গেছে, মানুষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আস্থা হারালেও অর্থনৈতিক নীতির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। অনাস্থার পাল্লা এভাবে ভারী হতে থাকলে ভবিষ্যতে আশা করার মতো লোকই পাওয়া যাবে না। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ একবার বলেছিলেন, রাষ্ট্র মানচিত্রে থাকে না, রাষ্ট্র থাকে মানুষের হৃদয়ে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ তথা নাগরিকই সবকিছুর নিয়ামক। সেই নাগরিকদের বৃহত্তর অংশ যখন দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে মনে করেন, তখন চিন্তারই কথা। এখানে সবচেয়ে বেশি হতাশা প্রকাশ করেছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। ২০১৯ সালে যেখানে ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা অর্থনীতি সঠিক পথে চলছে বলে মন্তব্য করেছেন, এখন সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে।

সামগ্রিকভাবেই ২০১৭ সাল থেকে দেশের নীতি–পরিকল্পনা সম্পর্কে মানুষের ইতিবাচক ধারণা কমে গেছে। ২০১৯ সালে ৫ হাজার টাকা বা তার চেয়ে কম আয়ের ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন যে দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে রয়েছে। ২০২৪ সালে এই হার দুঃখজনকভাবে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। এর প্রধান কারণ মূল্যস্ফীতি বা নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বছরের মাঝামাঝি মূল্যস্ফীতি কমে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও অর্থনীতিবিদেরা ভরসা পাচ্ছেন না।

এই জরিপে গণতন্ত্র কী, প্রশ্নের উত্তরে যে ৩৩ শতাংশ জানি না বলে মন্তব্য করেছেন, সে জন্য ক্ষমতাসীনেরা ‘কৃতিত্ব’ দাবি করতে পারেন। যে দেশে রিকশাচালক থেকে শুরু করে চা বিক্রেতা পর্যন্ত রাজনীতির বিষয়ে অতিশয় সচেতন, সে দেশে জরিপে এই ফলাফল কেন হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের সাম্প্রতিক কালের নির্বাচনগুলোর দিকে তাকাতে হবে।

এই জরিপ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বেশির ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক প্ল্যাটফর্মকে বিভিন্ন খবরের উৎস হিসেবে বেশি ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে অর্ধেকের কমসংখ্যক উত্তরদাতা মনে করেন, এসব মিডিয়া পুরোপুরি স্বাধীন। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা রাষ্ট্রীয় নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণে জরিপের মতামত মনে রাখলে ভালো করবেন।