আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীর জন্য সর্বজনীন অর্থে আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষা কার্যক্রমে নানাভাবে যুক্ত হয়ে আছে বাড়তি চাপ। ফলে শিক্ষা একটি শিশুর মানসিক বিকাশে যতটা না সহায়তা করে, তার চেয়ে বেশি ব্যাহতই করে।
সেই বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে মূলত শ্রেণিকক্ষের মধ্যে পাঠদান পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন না হওয়ায়। অথচ সেটিই হওয়ার কথা ছিল। শ্রেণিকক্ষের বাইরে ঘরে প্রাইভেট শিক্ষক রাখা, কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকদের আলাদা ব্যাচে পড়া আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে।
এর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কতটা গভীর সংকট বা ক্ষত তৈরি হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় ধারাবাহিকভাবে নানা সংস্কার আসছে, কিন্তু কোচিং-প্রাইভেট-গাইড বইনির্ভরতা কোনোভাবেই কমছে না। এর চেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় আর হয় না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে। প্রাইভেট টিউটরের কাছে না পড়লে শিক্ষার্থীরা ‘অপ্রত্যাশিত সমস্যায়’ পড়ে। এমনকি প্রাইভেট টিউটরের কাছে না পড়লে শিক্ষার্থী ফেল করবে, এমনটিও মনে করেন অনেক অভিভাবক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম দেশের উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলা—গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারীর ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৪০৮ জনের ওপর জরিপ করে প্রাথমিক শিক্ষার এসব তথ্য উঠে এসেছে।
তিনটি জেলায় এ জরিপ চালানো হলেও দেশের অন্য জেলাগুলোর চিত্র ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে এমন বাস্তবতা আরও বেশি প্রকট, তা জরিপ ছাড়াই অনুমান করা যায়। তবে গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারীর মতো জেলাগুলোর বাস্তবতা আরও বেশি করুণ।
জরিপেই উঠে এসেছে, এসব জেলায় দারিদ্র্যের হার ও বাল্যবিবাহের হার জাতীয় হারের চেয়ে দ্বিগুণ বা কয়েক গুণ বেশি। ফলে এখানে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে প্রাইভেট বা কোচিংনির্ভরতা এবং এর জন্য যে বাড়তি খরচ, তা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর আরও বেশি চাপ তৈরি করছে। এভাবে চলতে থাকলে সেখানে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যেতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা করছি আমরা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় একটি সমস্যা সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির প্রবণতা আছে। অনেক শিক্ষক সেসব এলাকায় থাকতে চান না, ফলে দেনদরবার করে বদলি হয়ে যান।
এ কারণে অনেক সময় পদও শূন্য থাকে। প্রত্যন্ত জেলাগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমকে মজবুত করতে শিক্ষকসংকট দূর করা অত্যন্ত জরুরি। উঁচু মানের শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত তাঁদের উপস্থিতিই পারে প্রাইভেট বা কোচিংনির্ভরতা থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের রেহাই দিতে।