‘কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো.../ কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।’ জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ছবিলাপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক এস এম জুলফিকার আলীর বটগাছের প্রতি গভীর মমতাময় ভালোবাসার গল্প পড়ার পর জাতীয় সংগীতের এ দুটি লাইন মনে পড়বে। কয়েক দশক ধরে তিনি বটগাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের পথে পথে। শুধু গাছ লাগিয়েই থেমে নেই তিনি, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও পাঠাগার গড়াতেও এগিয়ে তিনি। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম ও সমাজসেবা তৈরি করেছে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা।
উপজেলার কে জি এস মহর সোবাহান মফিজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জুলফিকার আলী (৫৬)। উপজেলার সেরা শিক্ষক হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮২ থেকে জুলফিকার আলী বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগানো শুরু করেন। এখনো তিনি অবিরাম গাছ লাগিয়ে চলেছেন।
শুধু মেলান্দহই নয়, জামালপুর সদর উপজেলা, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ীতেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর গাছ। বটগাছের প্রতি তাঁর গভীর মায়া। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক বটগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১০ হাজার গাছ তিনি লাগিয়েছেন বলে জানালেন। আর প্রতিবছর তাঁর স্কুলের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের গাছের চারা উপহার দিয়ে বিদায় জানান তিনি। যেকোনো বিয়েতেও উপহার হিসেবে নিয়ে যান গাছের চারা। এ নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করলেও তা থেকে তিনি বিরত থাকেননি। এভাবে শিক্ষার্থী ও মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দেন বৃক্ষপ্রেম।
বটের চারা বেশি লাগান কেন, জানতে চাইলে জুলফিকার আলী বলেন, ‘বটের ছায়া শীতল। সেখানে একত্রে অনেক মানুষ বসতে পারে। বটগাছ সহজে মরেও না। দেশে একসময় অনেক বটগাছ ছিল। এখন সংখ্যায় কমে এসেছে। বটগাছ লাগালে আমি আলাদা শান্তি পাই।’
গ্রামের কোথাও বাল্যবিবাহের খবর পেলেই ছুটে যান জুলফিকার। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে বাল্যবিবাহের হাত থেকে কিশোরীদের রক্ষা করেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় অনেক কিশোরী বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেয়েছে। মানুষকে বই পড়ায় আগ্রহী করতে এই শিক্ষক ২০০১ সালে বাড়ির সামনে নিজের জায়গায় গড়ে তোলেন একটি পাঠাগার। পুকুরপাড়ে বটগাছের ছায়ায় বসে বই পড়ার ব্যবস্থাও করেন। তবে সরকার পতনের পর দুর্বত্তরা পাঠাগারটির বইগুলো পুকুরে ফেলে দেয়। তাঁর মতো মানবিক মানুষের এমন উদ্যোগে কারা বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায়, আমরা জানি না। তবে এ ব্যাপারে আমরা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জুলফিকার আলীর মতো মানুষদের আমাদের বড্ড প্রয়োজন। যারা তাঁর ক্ষতি করতে চায়, তাদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
আশার কথা, নতুনভাবে আবারও পাঠাগারটি চালুর উদ্যোগ নিচ্ছেন জুলফিকার। স্থানীয় প্রশাসন তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসবে, সেটিই কাম্য। আমরা এই অদম্য শিক্ষককে জানাই অভিবাদন।