বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরাতে হবে

সম্পাদকীয়

বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হতে চান না—এটা আমাদের জানা খবর। কিন্তু কেন সাক্ষ্য দিতে চান না, সেটার সুনির্দিষ্ট কারণগুলো নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা–পর্যালোচনা নেই। ‘ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীর অনুপস্থিতি: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক পুলিশ সদর দপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রথম আলো এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সহিংসতার ভয়, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব, আসামিপক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শন, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অভাব ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাক্ষীরা আদালতে যেতে আগ্রহী নন। সাক্ষীদের ৭৯ শতাংশ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাবের কথা জানিয়েছেন। আসামিদের হুমকির কথা বলেছেন ৭৭ শতাংশ। ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন, আদালতে বিশ্রামের জায়গা নেই। ৫১ শতাংশ জানিয়েছেন, রাষ্ট্র সাক্ষীদের সুরক্ষা দেয় না।

সাক্ষী অনুপস্থিত থাকলে মামলা ঝুলে থাকে। সাক্ষীর অভাবে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। ফলে মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়, অনেক ক্ষেত্রে মামলা খারিজ হয়ে যায়। এতে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও বেশি উৎসাহী হয়।

সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পুলিশ কর্মকর্তারা কতটা ভূমিকা রাখেন, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে। বেশ কয়েকজন সাক্ষী জানিয়েছিলেন, অনুমতি ছাড়াই পুলিশ তাঁদের সাক্ষী বানিয়েছে। অনুমতি ছাড়া বা জোর করে সাক্ষী বানানো বন্ধ করতে হবে। এভাবে সাক্ষী বানালে কোনো ব্যক্তি যে সাক্ষ্য দিতে চাইবেন না, সেটা খুব স্বাভাবিক বিষয়।

সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্য নেওয়া, সাক্ষীদের যাতায়াত ও খাওয়ার খরচ দেওয়া, মামলার শুনানি নিয়মিত ও দ্রুত করা এবং আদালতে বিশ্রামাগার, পরিচ্ছন্ন টয়লেট, প্রার্থনা ও খাবারের ব্যবস্থা করলে সাক্ষীদের উপস্থিতি বাড়ানো যাবে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে বলে আশা করি।

পরিহাস হলো, প্রায় দেড় যুগ ধরে সাক্ষী সুরক্ষা আইন করা হবে বলে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইন কমিশনের সুপারিশ এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। এরপরও কেন আইনটি করা হচ্ছে না, তা নিয়ে সরকারের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

লক্ষণীয়, গবেষণা অনুসারে সাক্ষীদের ৭৯ শতাংশ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি তাঁদের আস্থার অভাবের কথা জানিয়েছেন। এ তথ্য যেমন বাস্তব, তেমনি উদ্বেগজনক। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি এই অনাস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। তাই এটা দূর করতে হলে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাই।