জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক বন্ধন সুদৃঢ় হোক

সম্পাদকীয়

বর্তমানে বাংলাদেশ যে একটা অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর থেকেই স্বার্থান্বেষী মহল নানা অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের ভেতরে ও সীমান্তের ওপারে চলছে অপপ্রচার ও উসকানি।

বিষয়টি হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যেত, যদি না দেশে একজন হিন্দুধর্মীয় নেতার গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে নানা অপপ্রচার চালিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনা না ঘটানো হতো। প্রথমে দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সমর্থকেরা কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে বিক্ষোভের নামে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেন। কয়েক দিন পর এক মাস আগে গঠিত হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি নামে একটি সংগঠন আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এখানেই শেষ নয়। দেশের ভেতরে ও বাইরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের আজগুবি অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট মহলের অপপ্রচার অব্যাহত আছে, যা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।

এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ছাত্রনেতৃত্ব ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ধারাবাহিক আলোচনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বিশেষ করে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় তাঁরা নির্দ্বিধায় মনের কথা প্রকাশ করেছেন। অতীতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সব ধর্মের মানুষকে এক বৈঠকে বসানোর উদাহরণ নেই। সেদিক দিয়ে এটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে সব নাগরিককে কাঠামোগত পরিবর্তন না করে ক্রোধ ও ভয় থেকে মুক্ত হয়ে একটি সহনশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পরামর্শ দেন, যেখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না বা এমন কোনো ঘটনা ঘটলেও তা সমাধান করা যাবে। এর আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি পরিবার হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন। আলোচনায় অংশ নেওয়া রাজনীতিক, ছাত্র ও ধর্মীয় নেতারাও শান্তি ও সম্প্রীতির এবং স্বাধীন অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করেছেন।

আমরা প্রধান উপদেষ্টার এই ধারাবাহিক আলোচনাকে স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যদি পারস্পরিক ভুল–বোঝাবুঝি থেকে থাকে, তার অবসান হবে আশা করা যায়। এসব বৈঠকে সংখ্যালঘু  সম্প্রদায়ের শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রশমনে যেসব সুপারিশ ও পরামর্শ এসেছে, সরকার সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে আশা করি।

বাংলাদেশের মানুষ যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখে, সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন রাষ্ট্রীয় নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ ও এর বাস্তবায়নে ধর্ম ও জাতিনির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে। কাউকে পেছনে ফেলে কিংবা অগ্রাহ্য করে গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা যাবে না।

আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। প্রতিবেশী দেশ কিংবা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই অপপ্রচার আসুক না কেন, আমরা সঠিক তথ্য দিয়ে তা খণ্ডন করব। তাদেরকে তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে হবে। তবে কোনো পক্ষের উসকানিতে পা দেব না কিছুতেই। দেশের অভ্যন্তরে যাতে কোনো রকম বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি না হয়, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। দেশের এই ক্রান্তিকালে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে কোনো সম্প্রদায়ের একজন নাগরিকও নিজেকে অনিরাপদ ভাবেন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সেটাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

একটি সমতাভিত্তিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আমরা সব ধরনের অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেব।