নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি

সম্পাদকীয়

অ্যান্টিবায়োটিক একধরনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, যা সাধারণত রোগ প্রতিরোধের শেষ অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা ও পরামর্শ পুরোপুরি মেনে না চললে রোগীর শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এমনকি ভুল অ্যান্টিবায়োটিকে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কাও থেকে যায়।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে করোনা রোগীদের ৭৫ শতাংশকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল প্রয়োজন ছাড়াই। অ্যান্টিবায়োটিকের এই অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

 সংক্রামক রোগবিষয়ক সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস-এ প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে করোনাকালে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, করোনার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন ছিল খুবই সীমিত, কিন্তু বাংলাদেশে অত্যধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে।

পাঁচটি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৩ হাজার ৬৯৩ জন করোনা রোগীর ওপর গবেষণা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা কম।

গবেষণায় যুক্ত বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর থাকা না–থাকার সঙ্গে এর ব্যবহারের সম্পর্ক আছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্যের বিষয়।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ছাড়াও একাধিক প্রতিষ্ঠান বলে আসছিল যে ব্যাপক ব্যবহারের কারণে কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। মহামারি শুরু হওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়ে যায়, প্রয়োজন আছে কি নেই, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি হাসপাতালের ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর। অর্থাৎ বাকি ৭৫ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার ছিল না।

সাধারণত সাত দিন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে বলা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, ১ হাজার ২১৬ জন রোগীকে ১০ দিনের বেশি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এমন রোগী পাওয়া গেছে, যাঁকে ৩২ দিন ব্যবহার করতে বলা হয়। যেসব অ্যান্টিবায়োটিক বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল, এর মধ্যে আছে সেফট্রিয়াক্সন, কো-অ্যামোক্সিক্লেভ, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, মেরোপেনাম।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বৈশ্বিক সমস্যা হলেও বাংলাদেশে এর মাত্রাটা অনেক বেশি। কেবল করোনাকালে নয়, অন্য সময়েও অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের দায় আছে। অনেক চিকিৎসক দ্রুত নিরাময়ের জন্য রোগীকে বেশি মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। আবার অনেক রোগী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে ব্যবহার করে থাকেন। আগের অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ না হলে অন্যটি ব্যবহার করেন।

অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি ও ব্যবহারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ থাকা প্রয়োজন। ২০১৬ সালে ওষুধ বিক্রির নীতিমালায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল, যদিও তা কার্যকর হয়নি। ওই নীতিমালায় ফার্মেসিগুলোতে ফার্মেসি কাউন্সিল অব বাংলাদেশের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট (গ্রেড এ, বি ও সি) ছাড়া ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ও নিষিদ্ধ করা হয়।

বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের মানসম্মত নীতিমালা প্রণীত না হওয়াও এর যথেচ্ছ ব্যবহারের অন্যতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১১ সালে হসপিটাল অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন প্রণয়ণ করেছে। আমরা মনে করি, এর আলোকে বাংলাদেশেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।

 করোনায় অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা তো পূরণ করার কোনো সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে এর যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে পারলে মানুষ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও চিকিৎসার নামে অর্থের অপচয় থেকে রেহাই পাবেন আশা করা যায়।