ন্যূনতম মজুরি কতটা বাস্তবসম্মত হলো

সম্পাদকীয়

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে সরকার নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে। মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর ২০২৩) মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় মালিকপক্ষের দেওয়া প্রস্তাব গ্রহণ করে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১২ হাজার ৫০০ টাকা।

এ ছাড়া আগের মজুরিকাঠামোতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন এ মজুরি কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর থেকে। টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাজারদর ও জীবযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম এই মজুরি কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল।

গত ২২ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিক প্রতিনিধিরা নিম্নতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিপরীতে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর এক দিন পরই আশুলিয়া, মিরপুরসহ দেশের কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হয়। সংঘর্ষে দুজন শ্রমিক নিহত হন। অসন্তোষের জেরে ছয় শতাধিক কারখানা বন্ধ রাখেন মালিকেরা। নতুন মজুরি নির্ধারণের পর গতকাল গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক নারী নিহত হয়েছেন।

চূড়ান্ত হওয়া মজুরি প্রস্তাব অনুযায়ী, মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অথচ শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাবে মূল বেতন ৬১ শতাংশ করার পাশাপাশি সাতটির বদলে পাঁচটি গ্রেড প্রবর্তন, এক গ্রেড থেকে আরেক গ্রেডে মজুরির পার্থক্য ১০ শতাংশ, গ্র্যাচুইটি প্রবর্তন ও রেশনব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের বয়স চার দশকের বেশি সময় হলেও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এ খাতের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। পোশাকশ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ হাজার টাকা। ডলারের বিনিময় হার বিবেচনায় সে সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত ডলারের দাম বিবেচনায় নিলে মজুরি দাঁড়ায় ১১৩ ডলারের মতো।

চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীনে এ শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩০৩ ডলার। রপ্তানিতে বাংলাদেশের পরে আছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ১৭০ ডলার, ১৭১ ডলার, ২০০ ডলার ও ২৪৩ ডলার। এ দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বের একই বাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দেশের পোশাক কারখানার মালিকেরা পারলে বাংলাদেশের মালিকেরা কেন পারেন না?

কয়েক দশক ধরে বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ব্র্যান্ডিং হলো সস্তা শ্রমের শ্রমিক। কিন্তু সেটা কতটা পর্যন্ত সস্তা হতে পারে? কত দিন পর্যন্ত সস্তা থাকতে পারে? কারখানার উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে শ্রমিকদের খেয়ে-পরে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। যে জায়গায় তাঁরা থাকছেন, সেই বাসস্থানটা স্বাস্থ্যকর হতে হবে। কিন্তু যে মজুরিটা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তাতে একজন শ্রমিকের পক্ষে তাঁর পরিবার নিয়ে ভালোভাবে টিকে থাকা কতটা সম্ভব? এই মজুরি কতটা বাস্তবসম্মত হলো?

ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি পোশাকশিল্প সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা পাওয়ার দিক থেকেও সবচেয়ে এগিয়ে। অন্য শিল্পকারখানাকে যেখানে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, সেখানে পোশাক কারখানার জন্য এই করের হার ১০-১২ শতাংশ। এ ছাড়া নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া ও শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা পান পোশাকশিল্পের মালিকেরা। এতটা সুবিধা পাওয়ার পরও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ায় এতটা পিছিয়ে থাকা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।

মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ অব্যাহত থাকলে পোশাকশিল্পের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। আমরা মনে করি, বর্তমান বাজার বিবেচনায় পোশাকশ্রমিকদের মজুরি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত করার সুযোগ রয়েছে।