পরিবেশ রক্ষা ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না। পরিবেশ রক্ষা যে উন্নয়নের অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ, এ কথা নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় বুঝতে চান না। অথবা বুঝলেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের কাছে তাঁরা বিবেক বন্ধক রেখে নিশ্চুপ থাকেন।
এ কারণে গত শুক্রবার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন) আয়োজিত জাতীয় সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য রেহমান সোবহানের বক্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, যেহেতু রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা দেশের পরিবেশ ধ্বংস করছেন, সেহেতু ক্ষমতার কেন্দ্রে গিয়ে পরিবেশবাদীদের কথা বলতে হবে।
এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে ক্ষমতাবানেরা উন্নয়নের নামে দেশের নদী, বন, খাল-বিল ধ্বংস করছেন। কিন্তু তাঁদের অজানা নয় যে এসব কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পদ নয়। এসব হলো জনগণের সম্পত্তি। সরকার চাইলেও কাউকে তা ইজারা দিতে পারে না। আবার এ কথাও ঠিক যে উন্নয়ন করতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ পুরোপুরি অক্ষত রাখা যাবে না।
আমরা যদি ঢাকা শহরের ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখব ১৬১০ সালে এই শহরের পত্তন ঘটে। পরবর্তীকালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ঢাকা সুবে বাংলার রাজধানী হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার আগপর্যন্ত এটি ছিল প্রাদেশিক রাজধানী এবং এর লোকসংখ্যা ছিল কয়েক লাখ মাত্র। বর্তমানে ঢাকার লোকসংখ্যা দেড় কোটির বেশি। শহরের বিস্তৃতিও ঘটেছে অনেক।
কিন্তু যে বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে, সেই বুড়িগঙ্গা দূষণ ও দখলের কারণে একটি মুমূর্ষু নদীতে পরিণত হয়েছে। কেবল তা-ই নয়, ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে যে পঞ্চাশটির অধিক খাল ছিল, সেসবও দখল হয়ে গেছে। কেবল বুড়িগঙ্গা নয়, ঢাকার চারপাশে প্রবাহিত তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু নদ নিয়েও একধরনের চোর-পুলিশ খেলা চলছে। একদিকে নদীর দুই তীরের অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান চালায়, অন্যদিকে প্রভাবশালীরা ভরাট করতে মেতে ওঠে।
একইভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানেরা দেশের সংরক্ষিত অনেক বনও ধ্বংস করে ফেলেছেন, যা থেকে সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনও রেহাই পায়নি। পরিবেশ রক্ষায় একটি দেশে যে পরিমাণ বনাঞ্চল থাকা দরকার, বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক কম আছে। তারপরও প্রভাবশালীরা একের পর এক বন দখল করে নিচ্ছেন। পরিবেশবাদীদের আন্দোলন কিংবা সেসব বন ও পাহাড়ের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্তনাদ তাঁদের কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার কৃষিজমি নষ্ট করে শিল্পকারখানা না করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্ক করে দিলেও তাঁরা আমলে নিচ্ছেন না।
এ কারণেই রেহমান সোবহান পরিবেশবাদীদের ক্ষমতাকেন্দ্রে যাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের বুঝতে হবে যে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারে কেউ পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন করছেন না। করছেন দেশ ও মানুষকে বাঁচানোর জন্য। অতএব, পরিবেশবাদীদের আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখার সুযোগ নেই। টেকসই উন্নয়ন ও বৃহত্তর জনগণের স্বার্থেই তাদের দাবি আমলে নিতে হবে।
সবশেষে বলব, পরিবেশ রক্ষার কাজটি কেবল পরিবেশবাদীদের নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়ই বেশি। যাঁরা পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করছেন, তঁাদের দু-চারজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেও অন্যদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমবে বলে আশা করা যায়।