বাংলাদেশে বেকারত্ব যে কত প্রকট রূপ নিয়েছে, তা জানার জন্য গবেষণার প্রয়োজন হয় না। জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে বিদেশ গমন–ইচ্ছুক তরুণদের ভিড় দেখলেই ধারণা করা যায়। দেশে চাকরির ব্যবস্থা থাকলে বিদেশে যাওয়ার জন্য তরুণেরা এভাবে হন্যে হয়ে উঠতেন না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জুন মাসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছে, দেশে এক বছরে বেকার বেড়েছে দেড় লাখ।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে যুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে দেশীয় বাজারে খুব বেশি হলে ১২ থেকে ১৩ লাখের কর্মসংস্থান হয়। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় ন্যূনতম মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে, বাকিরা শোভন চাকরিতে যান। আর প্রতিবছর ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ প্রবাসে যান। বাকিদের কাজের কোনো সুযোগ নেই।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে কাজের প্রত্যাশায় গড়ে প্রতি ঘণ্টায় দেড় শ বাংলাদেশি দেশ ছাড়ছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশিদের জন্য যত নতুন কর্মসংস্থান হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে প্রবাসে। স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৮। এ থেকেই দেশের বেকারত্বের মাত্রা ধারণা করা যায়। দেশে শোভন কাজ না পেয়ে ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় অনেক বাংলাদেশি তরুণ ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করছেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বিদেশের কারাগারে বন্দী বাংলাদেশির সংখ্যাও কয়েক লাখ।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, চাকরির সিংহভাগই তৈরি হয় বেসরকারি খাতে। কিন্তু শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ধরনের ব্যর্থতা আছে।
বেকারত্বের কারণ যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বড় বড় প্রকল্প হয়েছে, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় বেসরকারি খাতের প্রসার তেমন ঘটেনি। শিল্পকারখানার জন্য যে অপরিহার্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তার সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। সরকার ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বললেও বেশির ভাগের কাজই শুরু হয়নি। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এতটাই সেকেলে যে যুগের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এ কারণে আমরা বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কর্মী আনি আর আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা বেকার থাকেন।
বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩–এর গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল প্রতিবেদন অনুসারে, প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ-তরুণী শিক্ষা-কর্ম বা প্রশিক্ষণে নেই। পুরুষদের মধ্যে এ হার প্রায় ১৯ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে এ হার প্রায় ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক তরুণ ও তরুণী বেকার বা ছদ্মবেকার জীবন যাপন করছেন।
দেশে বেকারত্ব কমাতে হলে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পুরোপুরি চালু করতে হবে। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে হবে, যাতে কর্মবাজারে তাঁদের চাহিদা থাকে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির চেয়ে কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে, এত দিন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যেসব সুবিধা পেয়েছি, সেটা কমে যাবে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছে। তারা বেকারত্ব নিরসন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দেবে আশা করি।